‘লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সরকারের লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’

0
0


শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। লেখক-শিল্পী- বুদ্ধিজীবীদেরও সরকারের লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ তারাই ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারেন। যদি একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ না পান, তাহলে সৃজনশীলতার জন্ম হয় না, শিল্প কেবল আনুগত্যের হাতিয়ার হয়ে পড়ে। ‘সংস্কৃতিখাতে বাজেট পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে কথাগুলো বলেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক আনু মোহাম্মদ।

আজ (১৮ এপ্রিল) শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ছিল সংস্কৃতিখাতের বাজেট প্রস্তাবনা নিয়ে সেমিনার। বিকেলে থিয়েটার আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ঢাকার (টাড) আয়োজনে সেমিনারকক্ষে ‘সংস্কৃতিখাতে বাজেট পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু ‍মুহাম্মদ।

নাট্যজন ও টাড সভাপতি আজাদ আবুল কালামের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তৃতা দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নৃত্যশিল্পী ও গবেষক লুবনা মারিয়াম, সংগীতশিল্পী সুজিত মোস্তফা, শেখ জসিম, আবৃত্তিকার গোলাম সারোয়ার, শিল্পসমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ, আলোকচিত্রী কে এম জাহাঙ্গীর আলম, যন্ত্রসংগীতশিল্পী রিপন খান, বাজেট বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমাদের দেশে প্রাক-বাজেট আলোচনায় কৃষক থাকেন না, শ্রমিক থাকেন না, সংস্কৃতিকর্মী থাকেন না। অথচ এই তিনটি শ্রেণিই সমাজের ভিত্তি। তাদের অভাব, তাদের বঞ্চনা, এবং তাদের দাবিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নীতিনির্ধারক পরিসরে তাদের কোনো জায়গা নেই।

তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে যদি সত্যিকার অর্থে মানবিক ও সৃজনশীল সমাজ গঠন করতে হয়, তাহলে সেখানে লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, নাটকের মঞ্চ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট অবকাঠামো থাকা জরুরি। অথচ আমরা দেখছি, দিন দিন এসব জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, একটা সময় বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি লেখা হতো। সেই সব দেয়ালে লেখা স্বপ্নগুলো আজ চাপা পড়ে গেছে। এখন আমরা দেখছি, এক শ্রেণির আষ্ফালনে সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসর ছোট হয়ে আসছে, ভয় এবং নিয়ন্ত্রণের আবহে সাংস্কৃতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান সরকারের সামনে এই বাজেট একটি পরীক্ষা। তারা কি সত্যিই সংস্কৃতির উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ বাড়াবে? নাকি তারা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চাপ ও মদদে এমন পদক্ষেপ নেবে, যা আরও বেশি সংকোচন ও দমননীতিকে উৎসাহিত করবে? আমরা যেটা বুঝি, যে সমাজে শিক্ষকের সম্মান নেই, সেখানে শিল্পীর অবস্থান আরও করুণ হয়। আজ শিক্ষকদের অবস্থা ভালো না, আর শিল্পীদের অবস্থা তো একেবারে শোচনীয়।

বাজেটের অর্থ জনগণের। সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, সরকার প্রায়ই বলে, “আমরা তো অনেক টাকা বরাদ্দ করেছি।” কিন্তু এই টাকা সরকারের নিজস্ব টাকা নয়, এই টাকা জনগণের টাকা। কাজেই তাদের দায়িত্ব, এই টাকা জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি, বড় অংশের বাজেট চলে যাচ্ছে লুটপাট, অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় খাতে, যেটা জনগণের নয়, গোষ্ঠীস্বার্থের সেবা করে। তাই আমাদের এই কথাগুলো বারবার বলতে হবে। পাবলিক মানি কীভাবে পাবলিকের কাজে লাগবে, সেই দাবি তোলাই আমাদের দায়িত্ব।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি—যারা দায়িত্বে ছিলেন—তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য জাতি অনেক কিছু হারিয়েছে। আজ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করছে না, বরং তারা কোনো কোনো সময় নিরপেক্ষতার বদলে অনুগত শিল্পীদের প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু অনুগত শিল্পী দিয়ে কোনো রাষ্ট্র সৃজনশীল ভবিষ্যত গড়তে পারে না। তাই আমাদের কথা বলা বন্ধ করা যাবে না। বারবার বলতে হবে, উচ্চারণ করতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে জনমানসে। জনগণের মধ্যে এই বোধ ছড়িয়ে দিতে হবে যে, সংস্কৃতির অধিকার মানেই তাদের জীবনের অধিকার, সমাজের ন্যায্যতার প্রশ্ন।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যার জন্ম হয়েছে ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। অথচ দুঃখজনকভাবে আমরা দেখছি, যেই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, সংস্কৃতিকে বরাবরই গৌণ মনে করেছে। এই মনোভাবের ফলে, রাষ্ট্র যখন সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয় না, তখন সাধারণ মানুষের মনেও এর গুরুত্ব কমে যায়।’ সেমিনারে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ খাতের সংকট, চাহিদা এবং নীতিগত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। সংস্কৃতি খাতে দীর্ঘদিনের অবহেলা কীভাবে শিল্পচর্চার ধারা ও শিল্পীদের জীবনমানকে বিপন্ন করছে, সেদিকেও আলো ফেলেন এই শিল্পীরা।

এমআই/আরএমডি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।