ফেসবুকে বিপরীত জেন্ডারের কারো ছবিতে রিএ্যাক্ট করা, তাদের সঙ্গে প্রাইভেট মেসেজ আদান-প্রদান, বা আগের চেয়ে বেশি সময় চ্যাট করা – এগুলো অনেকের কাছে সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু আপনার রোমান্টিক পার্টনার এই আচরণগুলোকে দেখতে পারেন মাইক্রোচিটিং হিসেবে। এটি সরাসরি প্রতারণা নয়, বিষয়টি আরও সূক্ষ্ণ।
আপনার হয়তো মনে হতে পারে আপনার সঙ্গী বুঝি একটু বেশিই প্রোটেক্টিভ বা পোজেসিভ। তবে প্রতিটি মানুষ তার সঙ্গীর কাছে এমন কিছু আচরণ আশা করে যা সে আর কারো সঙ্গে করবেনা। বর্তমান অনলাইন যোগাযোগের যুগে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। এক ধরনের সূক্ষ্ণ অবিশ্বাস কাজ করে অনেকের মধ্যেই, বিশেষত যখন আবেগী সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাধারণ হার্ট ইমোজি দিয়েও।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের অস্টিনভিত্তিক থেরাপিস্ট ও জাস্ট মাইন্ড কাউন্সেলিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম শ্রোডার বলেছেন, রোমান্টিক সম্পর্কে সীমানা ঠিক করা নতুন ধারণা না হলেও, রিমোট ওয়ার্কের যুগে এই সমস্যা আগের চেয়ে প্রকট হয়ে গেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, এখন মানুষ ডিজিটাল কানেকশনে বেশি জড়াচ্ছে, যা এই ধরনের আচরণের সুযোগ তৈরি করছে। ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের কারণে এটা আরও সহজ, কারণ এতে ঝুঁকি কম মনে হয়।
তবে যারা এসব আচরণে জড়াচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগ নিজেরাই জানেন যে আসলে এর কতটা উচিত, কতটা অনুচিত। যখনই আপনি নিজের সঙ্গীর কাছে এমন কিছু লুকাচ্ছেন কিন্তু নিজেকে বুঝ দিচ্ছেন যে এটা স্বাভাবিক, তখনই আপনি নিজের সঙ্গেই অসততা করে ফেলছেন। চলুন জেনে নেই এই মাইক্রোচিটিং বিষয়টি আসলে কী-
মাইক্রোচিটিং শব্দটি জনপ্রিয় করেছেন অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজিস্ট মেলানি স্কিলিং। মাইক্রোচিটিং হলো এমন আচরণ যা সম্পূর্ণ আবেগী বা শারীরিক সম্পর্কে পরিণত না হলেও পার্টনারের কাছে স্বীকার করা কঠিন। যেমন- গোপন অনলাইন চ্যাট, কোনো নির্দিষ্ট সহকর্মীর সঙ্গে বেশি সময় কাটানো, নিজের সম্পর্কের গোপন বিষয়গুলো অন্যকে জানানো, কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য বিশেষভাবে ড্রেসআপ করা ইত্যাদি।
‘রিলেশনশিপস্ মেড ইজি’ নামক একটি পডকাস্টের হোস্ট ও ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলির সাইকোলজিস্ট অ্যাবি মেডক্যাল্ফ বলেন, এটি এমন একটি বিষয় যা সবসময়ই সমাজে ছিল, আমরা শুধু একটি নতুন নাম দিয়েছি।
তিনি জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোর বেশিরভাগ উদাহরণই সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে টেক্সটিং বা মেসেজিংয়ের সঙ্গে জড়িত, এবং এই আচরণগুলো ধীরে ধীরে বড় সমস্যার দিকে মোড় নিতে পারে।
এই বিষয়টি যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ-
সম্পর্কের ধরন বদলাচ্ছে, বহুগামিতার মতো ধারণাও এখন অহরহ চোখে পড়ে। ফলে কেউ কেউ বলতে পারেন যে, একটা ফটো লাইক বা কমেন্ট করাটা এত বড় ব্যাপার না। মেডক্যাল্ফ বলেন, অনেক দম্পতিই এই আচরণগুলোকে স্বাভাবিক মনে করলেও, যারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, তাদের দোষী বোধ করার দরকার নেই। সম্পর্কের জন্য কোনো সার্বজনীন নীতিমালা নেই। এটি প্রতিটি ব্যক্তির স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার ওপর নির্ভর করে।
কোনো আচরণ সরাসরি নিষিদ্ধ না হলেও, তা সমস্যা তৈরি করতে পারে যদি তা আপনার মূল সম্পর্ক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়। তবে এটা তখনই প্রতারণা হয়ে যায় যখন আপনার পার্টনার এটা মানেন না, জানেন না, অথবা জানলে মন খারাপ করবেন।
তবে মেডক্যাল্ফ সন্দেহবশত পার্টনারের ফোন চেক করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেন, কেননা এটি অবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়। বরং আপনার সঙ্গী সামগ্রিকভাবে আপনার সঙ্গে কেমন আচরণ করছে, কতখানি প্রাধান্য দিচ্ছে, সেদিকে মনোযোগ দিন।
যুগলরা যেভাবে সামলাবেন-
১. সম্পর্কের শুরুতেই আপনার সঙ্গীর সঙ্গে বাউন্ডারি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলুন। কোন ধরনের আচরণ আপনাকে কষ্ট দিতে পারে, আপনার সঙ্গীর কাছে আপনার আশা কী, কী ধরণের আচরণ আপনার কাছে মাইক্রোচিটিংয়ের সমতূল্য, এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করুন। এগুলো জানার পরও যদি আপনার সঙ্গী এমন আচরণ করে, সেক্ষেত্রে আপনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শ্রোডারের মতে, প্রতিটি যুগল কিছু বাউন্ডারি সেট করে, কিছু স্পষ্টভাবে আলোচিত, কিছু অলিখিত। কিন্তু আজকাল এই সীমানাগুলো আরও অস্পষ্ট।
২. আদর্শভাবে, এই কথোপকথনগুলো কোনো ঝগড়া হওয়ার আগেই হওয়া উচিত, যদিও সঠিক সময় বেছে নেওয়া সহজ নয়। আচরণে পরিবর্তন, যেমন- ফোনে বেশি প্রোটেক্টিভ হয়ে যাওয়া, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত স্ক্রল করা, এগুলো সম্পর্কে সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। তবে শ্রোডার দোষারোপ না করে কথা বলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, পরিবর্তনটা উল্লেখ করে নিজের অনুভূতি শেয়ার করুন। অভিযোগের বদলে কৌতূহল নিয়ে কথা শুরু করলে ফলাফল ভালো হয়।
৩. মাইক্রোচিটিং সাধারণত নতুন সম্পর্কের রোমাঞ্চ খোঁজার ইচ্ছা থেকে জন্ম নেয়। যদিও অনেকেই এটাকে আর এগোতে দেয় না, তবুও নিজের সঙ্গে সৎ হওয়া জরুরি। আর মাইক্রোচিটিং মানেই সম্পর্কের শেষ না।
৪. অনুভূতি শেয়ার করার সময় একে অন্যের প্রতি সম্মান বজায় রাখুন।
৫. নিশ্চিত না হয়ে ব্লেম-গেম শুরু করবেন না।
মাইক্রোচিটিং বিষয়টি আমাদের সমাজে একটা ট্যাবু বিষয়ই বলা যায়। কারণ, এই বিষয়টি অনেক মানুষ অনুভব করলেও কীভাবে বলতে হবে তা জানেন না। অনেকে ‘এগুলো কোন বড় বিষয় না’ ভেবে নিজেকে বুঝ দেন, অনেকে হয়তো ভাবেন এসব কথা আলোচনা করলে হিংসুক তকমা লেগে যাবে। তবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার অনুভূতি এবং সঙ্গীর সঙ্গে আপনার বোঝাপড়াই সবথেকে জরুরি বিষয়। তাই মনে খচখচ করলে চেপে না রেখে সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলুন। ভালো থাকলে তবেই ভালো রাখতে পারবেন।
এএমপি/এএসএম