রাজবাড়ীতে রবি মৌসুমে আবাদের জন্য বীজ বিপণন বিভাগ (বিএডিসি) থেকে সরবরাহ করা পেঁয়াজ বীজ (পেঁয়াজের দানা) অঙ্কুরোদগম (গজানো) না হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার চাষি।
এ অবস্থায় নতুন করে বীজ বপনের সময় না থাকায় এবছর জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে আবাদের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এছাড়া বীজসহ সব কিছুর দাম বেশি হওয়ায় হালি পেঁয়াজের চারার দামও বাড়বে বলে ধারণা চাষিদের। চারা কিনে আবাদ করতে গেলে প্রতি বিঘায় ২০-২৫ টাকা বাড়তি খরচ হবে। এ অবস্থায় ক্ষতিপূরণ এবং কৃষি অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের শাস্তির দাবি জানান চাষিরা।
মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজ আবাদের সমৃদ্ধ জেলা রাজবাড়ী। সারাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এ জেলায়। উৎপাদনে দেশের তৃতীয় অবস্থানে রাজবাড়ী। জেলার পাঁচ উপজেলায় কমবেশি পেঁয়াজের আবাদ হলেও কালুখালী, বালিয়াকান্দি ও পাংশায় উল্লেখযোগ্য হারে আবাদ হয়। এবছর জেলায় প্রায় সাড়ে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে হালি পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া এবছর জেলায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজবাড়ীতে বিএডিসির সরবরাহকৃত বারি-১, বারি-৪ ও তাহেরপুরি জাতের ৪ হাজার কেজি বীজ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে চার হাজার কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এই বীজ বপনের পর দুই সপ্তাহের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখনো বারি-৪ ও তাহেরপুরি বেশির ভাগই অঙ্কুরোদগম হয় নাই। এরমধ্যে বারি-৪ একেবারেই গজায়নি। তবে বারি-১ গজিয়েছে। এদিকে একই সঙ্গে একই জমিতে বাজার থেকে কিনে বপন করা বীজ অঙ্কুরোদগম হয়েছে।
বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, সরবরাহ করা চার হাজার কেজির মধ্যে বারি-১ (৫০০ কেজি), বারি-৪ (১০০০ কেজি) ও তাহেরপুরি (২৫০০ কেজি)। যার প্রতি কেজির মূল্য ২ হাজার ৭০০ টাকা দরে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এই বীজ রাজবাড়ী জেলা সদরে ৮০০, গোয়ালন্দে ৪০০, পাংশায় ১০০০, বালিয়াকান্দিতে ১০০০ ও কালুখালী উপজেলায় ৮০০ সহ জেলায় মোট ৪ হাজার কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কালুখালীর পেঁয়াজ চাষি আব্দুল বাচ্চু খান বলেন, এবার সরকারিভাবে পেঁয়াজের দানা পেয়ে অনেক আশা নিয়ে বপন করেছিলাম। কিন্তু দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও একটা চারাও গজায় নাই। এখন আমি ৫ বিঘা জমিতে কীভাবে পেঁয়াজের চাষ করবো? আর এখন তো নতুন করে চারা বপন করার সময়ও নেই। এই মাস শেষেই পেঁয়াজ লাগাতে হবে। এখন সংসার চালাবো নাকি চারা কিনে পেঁয়াজ লাগাবো। এক বিঘা জমিতে চারা কিনে লাগাতে প্রায় ২৫ হাজার টাকা লাগবে। তাহলে ৫ বিঘা জমির চারা কিনে অনেক টাকা প্রয়োজন। আমার যে ক্ষতি হয়েছে এই ক্ষতিপূরণসহ বিচার চাই।
আরেক চাষি রাব্বি মোল্লা বলেন, এবছর আমি ৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগাতে দুই কেজি বীজ বপন করেছিলাম। এক কেজি সরকারিভাবে পাওয়া আরেক কেজি বাজার থেকে কেনা। এই বীজ একই সময় একই জমিতে পাশাপাশি বপন করেছিলাম। কিন্তু সরকারিভাবে পাওয়া বীজের একটাও হয়নি। অথচ বাজার থেকে কেনা বীজের সবগুলো গজিয়েছে। এখন চারার অভাবে আড়াই বিঘা জমি আমার পড়ে থাকবে। এই বীজ যারা দিয়েছে তাদের শাস্তি চাই এবং সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।
জাকির হোসেন নামে আরেক চাষি বলেন, আমি এবার ১০-১২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষের জন্য চারা দিয়েছি। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো বীজ পাই নাই। এক কেজির হাইব্রিড দানা ২৫-২৬ হাজার টাকায় কিনেছি। সরকারিভাবে পেলে আমরা উপকৃত হতাম। তবে যারা এবছর সরকারি বীজ পেয়েছে তাদের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। কারও একটা চারাও গজায়নি। এদের সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
হিরন বলেন, আমি ৭ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগানোর জন্য হাইব্রিড ও কিং জাতের বীজ কিনে এবং বারি-৪ সরকারিভাবে পেয়ে চারা দিয়েছিলাম। কেনা বীজ গজালেও বারি-৪ এর কিছুই গজায় নাই। এখন আমার দুই বিঘা জমি পড়ে থাকবে। আমার মতো যারা সরকারি বীজ পেয়েছে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চাষি জিল্লুর রহমান বলেন, এবছর বৃষ্টির কারণে আমাদের পেঁয়াজ লাগানো পিছিয়ে গেছে। তারপর আবার সরকার থেকে পাওয়া বীজ জ্বালায় নাই। নতুন করে চারা দেবে সে সময়ও নাই। এখন সরকার আমাদের ক্ষতিপূরণ দিলে কিনে লাগাতে পারবো। আর না দিলে জমি পরে থাকবে।
রাজবাড়ীর বীজ বিপণন বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক নিপুন কুমার নন্দী বলেন, আমরা কৃষকদের মাঝে বিতরণের জন্য রাজবাড়ী কৃষি বিভাগের কাছে ৩টি জাতের পেঁয়াজ বীজ সরবরাহ করেছি। এরমধ্যে বারি-১ জাতের কোনো অভিযোগ আসে নাই। তবে অন্য দুটি জাত বারি-৪ ও তাহেরপুরির না অঙ্কুরোদগম (গজানো) এর অভিযোগ এসেছে। বারি-৪ (১০০) ও তাহেরপুরি (২৫০০) কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে বারি-৪ এর সমস্যা বেশি। কি কারণে ক্ষতি হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছে। আশা করছি এ বিষয়ে বিএডিস ও মন্ত্রণালয় কৃষকদের পক্ষে ভালো সিদ্ধান্ত দেবে। এর আগে এই অঞ্চলে পেঁয়াজ বীজ নিয়ে এরকম কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন নাই এবং বীজের ভালো ফলাফল ছিল বিধায় চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বীজের প্রতি কেজির দাম ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বিএডিসির মাধ্যমে জেলার চার হাজার কৃষককে প্রণোদনার মাধ্যমে চার হাজার কেজি পেঁয়াজ বীজ দিয়েছি। মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা সেই বীজ বপনের ১২ দিন পর বীজতলা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বারি-১ জাতের বীজের অঙ্কুরোদগম সন্তোষজনক। তবে বারি-৪ ও তাহেরপুরি জাতের পেঁয়াজের অঙ্কুরোদগম সন্তোষজনক না। মাঠপর্যায় পর্যবেক্ষণ করে এই অবস্থা দেখে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট আকারে জানিয়েছি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে কৃষকদের ক্ষতি কীভাবে সমাধান করা যায়। আমরা সে মোতাবেক কাজ করবো এবং পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজের দাম বেশি হওয়ায় এ বছর রাজবাড়ীতে কৃষকরা প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের বীজতলা তৈরি করেছে। সেই বীজতলা থেকে ৩৮-৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা যাবে। বীজতলায় চারা ঠিকমতো গজালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমার চেয়ে বাড়বে।
রুবেলুর রহমান/জেডএইচ/এমএস