অল্প আয়ে সংসার চালানোর কৌশল

0
2


বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সারা বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা অনেক পরিবারকে আর্থিক চাপের মধ্যে ফেলেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এই প্রভাব স্পষ্ট। মাসের শুরুতেই বেতন পাওয়ার পর অর্ধেক মাস না যেতেই অনেকের আয় শেষ হয়ে যায়, ফলে বাকি দিনগুলো কাটানো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হলো, এই সংকটকালীন সময়ে অল্প আয়ের মধ্যে কীভাবে সংসার চালানো যায় এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখা সম্ভব?

এই পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিয়ে সংসার পরিচালনা করা সম্ভব, তবে এর জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও কিছু কৌশল। টাইমস অফ ইন্ডিয়া এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অল্প আয়ে সংসার চালানোর জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং অভ্যাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে (2022)। চলুন, এই সংকট মোকাবিলায় কিছু কার্যকরী পরামর্শ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. প্রয়োজন এবং চাহিদার মধ্যে পার্থক্য করা:

অল্প আয়ে সংসার চালানোর প্রথম পদক্ষেপ হলো প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদার মধ্যে পার্থক্য করা। আমরা প্রায়ই চাহিদাকে প্রয়োজন হিসেবে ভুল করি এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর পেছনে ব্যয় করি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এর ২০১৮ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ প্রয়োজনের তুলনায় চাহিদার পেছনে ব্যয় হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সংকট সৃষ্টি করে।

প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং পোশাকের মতো মৌলিক জিনিসগুলো। অন্যদিকে, চাহিদা বলতে বোঝায় এমন কিছু যা ছাড়া চলা সম্ভব, যেমন নতুন জামা-কাপড়, ব্যয়বহুল মোবাইল ফোন, এবং রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাস। সংকটের সময়ে প্রয়োজনীয়তার দিকে মনোযোগ দিয়ে চাহিদাগুলোকে সাময়িকভাবে সংযম করা জরুরি।

২. বাজেট তৈরি এবং খরচের হিসাব রাখা:

অল্প আয়ে সংসার চালাতে হলে বাজেট তৈরি করা অপরিহার্য। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর গবেষণায় বলা হয়েছে, সঠিক বাজেট পরিকল্পনার মাধ্যমে খরচ নিয়ন্ত্রণ করা এবং সঞ্চয় বাড়ানো সম্ভব (2021)। মাসের শুরুতেই আয় এবং খরচের একটি তালিকা তৈরি করুন এবং কোন খাতে কত ব্যয় হবে তা নির্ধারণ করুন। বাজেট অনুযায়ী খরচ করতে পারলে মাসের শেষে কিছু অর্থ সঞ্চয় করাও সম্ভব হবে।

৩. সঞ্চয়কে অগ্রাধিকার দিন:

সঞ্চয় করা মানে নিজের জন্য একটি নিরাপত্তার বেষ্টনী তৈরি করা। অল্প আয় হলেও সঞ্চয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। ন্যাশনাল এন্ডাওমেন্ট ফর ফিনান্সিয়াল এডুকেশন (NEFE) এর ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, যেসব পরিবার মাসিক আয়ের অন্তত ২০% সঞ্চয় করতে পারে, তারা আর্থিক বিপর্যয় থেকে ভালোভাবে রক্ষা পায়।

অল্প আয় থেকে প্রতিমাসে সামান্য অর্থ সঞ্চয় করুন এবং এই সঞ্চয়কে দীর্ঘমেয়াদে বাড়ানোর চেষ্টা করুন। সঞ্চয় করার সময় খরচের পরে বাকি অর্থ সঞ্চয় না করে বরং প্রথমেই নির্দিষ্ট একটি অংশ সঞ্চয় করুন এবং বাকি অর্থ দিয়ে সংসারের খরচ পরিচালনা করুন।

৪. বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা:

বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ের একমাত্র উৎসের উপর নির্ভরশীল হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অল্প আয়ে সংসার চালানোর জন্য পরিবারে বাড়তি আয়ের উৎস খুঁজে বের করা জরুরি। আপনার বা আপনার পরিবারের সদস্যের কোনো দক্ষতা থাকলে তা কাজে লাগিয়ে ঘরে বসে অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। যেমন, টিউশনি, ফ্রিল্যান্সিং, বা হস্তশিল্পের মাধ্যমে আয়ের নতুন উৎস তৈরি করা যেতে পারে।

গার্ডিয়ান এর ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্রিল্যান্সিং এবং অনলাইন কাজের মাধ্যমে মানুষ তাদের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে পারছে, যা তাদের আর্থিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে সাহায্য করছে।

৫. ছোট ছোট ঋণ পরিশোধ করতে থাকুন:

অল্প আয়ের মধ্যে সংসার চালানোর সময় ঋণগ্রস্ত থাকলে তা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। তাই, যতটুকু সম্ভব ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করুন। ঋণ কমানো এবং নতুন ঋণে না জড়ানোর জন্য পরিবারের সবাইকে একসাথে বসে আলোচনা করা প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক সংকট সবসময় স্থায়ী নয়, তবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ধৈর্য ধরলে এই সংকট কাটিয়ে উঠে সুদিনে ফিরে আসা সম্ভব।

ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (IMF) এর ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে আর্থিক সংকট কাটানো সহজ হয়। তাই, ঋণ পরিশোধের জন্য সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং সেই পরিকল্পনা মেনে চলুন।

৬. পরিবারের সবাইকে জড়িত করুন:

অল্প আয়ে সংসার চালাতে হলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে দায়িত্বশীল হতে হবে। পরিবারে সবার সাথে খরচ এবং সঞ্চয়ের বিষয়ে কথা বলুন। শিশুদেরও এ বিষয়ে সচেতন করা দরকার, যাতে তারা ছোট থেকেই অর্থের মূল্য বুঝতে শেখে।

ফরবস এর ২০১৯ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আর্থিক শিক্ষা যদি পরিবারে শুরু থেকেই দেয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য দায়িত্বশীল অর্থ ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম হয়।

৭. দৈনন্দিন খরচে সাশ্রয়ী হন:

দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট খরচেও সাশ্রয়ী হওয়া দরকার। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি — এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব মিতব্যয়ী হন। প্রয়োজন ছাড়া লাইট, ফ্যান বা এসি চালিয়ে রাখবেন না। বাইরে খাওয়ার বদলে ঘরে তৈরি খাবার খান।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এর ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবারগুলো ঘরের খাবার খেয়ে প্রায় ৩০% খরচ কমাতে পারে এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে পারে।

৮. বিনোদনের ক্ষেত্রে খরচ কমান:

সংকটকালীন সময়ে অপ্রয়োজনীয় বিনোদনের পেছনে অর্থ ব্যয় না করাই ভালো। সিনেমা বা রেস্তোরাঁয় যাওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া বিনোদন বেছে নিন, যেমন বই পড়া, মুভি দেখা বা পরিবারের সাথে সময় কাটানো। এতে যেমন খরচ বাঁচবে, তেমনই মানসিক প্রশান্তিও পাওয়া যাবে।

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে অল্প আয়ে সংসার চালানো একটি চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক পরিকল্পনা, বাজেটিং, সঞ্চয় এবং বাড়তি আয়ের মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সহযোগিতা, দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ী হওয়া এবং প্রয়োজন ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করে চলা আমাদেরকে এই কঠিন সময়ে টিকে থাকতে সাহায্য করবে।

অর্থনৈতিক সংকট সবসময় স্থায়ী নয়, তবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ধৈর্য ধরলে এই সংকট কাটিয়ে উঠে সুদিনে ফিরে আসা সম্ভব।

লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।

এইচআর/জেআইএম