নবিজি হজরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবুয়ত লাভের পর মক্কায় প্রায় ১৩ বছর ইসলাম প্রচার করেন। মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেন। সত্য দীন গ্রহণ করতে বলেন। আল্লাহর দীন গ্রহণ না করলে দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তির ব্যাপারে সাবধান করেন।
কিছু মানুষ নবিজির (সা.) দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেও মক্কার বেশিরভাগ মানুষ বিশেষত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। তারা বরং ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমে যথাসাধ্য বাঁধা সৃষ্টি করেছে। মুসলমানদের আল্লাহর দীন পালন করতে বাঁধা দিয়েছে। তাদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে।
মুসলমানদের নিপীড়িত অবস্থা দেখে নবিজি (সা.) প্রথম পর্যায়ে মুসলমানদের হাবাশায় হিজরতের অনুমতি দেন। কিছু মুসলমান হাবাশায় হিজরতও করেন। তারপর মদিনাবাসীর সাথে আলোচনা ও চুক্তি হলে নবিজি (সা.) মুসলমানদের মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। নিজেও মক্কার মুশরিকদের তাকে হত্যা করার চক্রান্ত নস্যাৎ করে মদিনায় হিজরত করেন।
মদিনায় হিজরতের পর মক্কার মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে বদরের বড় যুদ্ধ, তৃতীয় হিজরিতে ওহুদের বড় যুদ্ধ ও পঞ্চম হিজরিতে খন্দকের বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কোনো যুদ্ধের মক্কার মুশরিকরা বিজয়ী হতে পারেনি।
ষষ্ঠ হিজরিতে নবিজি (সা.) স্বপ্নে দেখেন, তিনি সাহাবিদের নিয়ে ইহরাম বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করছেন। নবিদের স্বপ্ন সত্য হয়। এই স্বপ্ন ইশারা করছিল যে নবিজি (সা.) ও তার সাহাবিরা কিছু কালের মধ্যেই মক্কায় ওমরাহ বা হজ পালনের সুযোগ পাবেন। নবিজির (সা.) স্বপ্নের কথা শুনে সাহাবিরা ওমরাহর জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাদের আগ্রহ দেখে নবিজিও (সা.) ওমরাহ পালন করতে আগ্রহী হন। ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবিজি প্রায় ১৪০০ সাহাবিকে নিয়ে ওমরাহর জন্য ইহরাম বেঁধে বের হন।
এই সফরে মক্কার মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছা নবিজির (সা.) ছিল না। তিনি শুধু ওমরাহ পালন করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা মুসলমানদের শান্তিপূর্ণভাবে ওমরাহ পালন করতে দিতে সম্মত হলো না। তারা মুসলমানদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিলো। ফলে নবীজি (সা.) সাহাবিদের নিয়ে হোদাইবিয়ায় অবস্থান নিলেন।
এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মক্কার মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের সন্ধি হয় যা ইতিহাসে ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি’ হিসেবে খ্যাত। হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তিতে উভয় পক্ষ একমত হয় যে, মুসলমানরা এ বছর ওমরাহ না করে ফিরে যাবে এবং পরের বছর ওমরাহ করার সুযোগ পাবে। তারা তিন দিনের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে মক্কায় অবস্থানের অনুমতি পাবে।
হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী পরের বছর অর্থাৎ সপ্তম হিজরিতে তারা ওমরাহ পালন করেন। নবিজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের এই ওমরাহটিকেই ‘ওমরাতুল কাজা’ বলা হয়। যেহেতু তারা আগের বছর ওমরাহর ইহরাম বেঁধেও ওমরাহ করতে পারেননি এবং এ বছর ওই ওমরাহর কাজা আদায় করেন।
সপ্তম হিজরির জিলকদ মাসে নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহর জন্য যাত্রা করেন এবং যারা আগের বছরের সফরে ছিল, তাদের কেউ যেন ওমরাহর সফরে যাওয়া থেকে বিরত না থাকে সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। মদিনার শাসক হিসেবে তিনি সাহাবি আবু জর গিফারীকে (রা.) রেখে যান।
নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ষাটটি, আরেক বর্ণনায় সত্তরটি কোরবানির পশু সঙ্গে নিয়েছিলেন। মুসলমানদের সঙ্গে আত্মরক্ষার জন্য অনেক অস্ত্রসস্ত্রও ছিল। কিন্তু হারাম এলাকার মধ্যে তারা অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করেননি। বরং হারাম এলাকার প্রান্তে অস্ত্র রেখে দেন যেন মুশরিকরা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটালে অস্ত্র কাছেই থাকে। কিছু সাহাবিকে এই অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত রাখা হয়।
মক্কার মুশরিকদের ধারণা ছিল, মদিনার জ্বরের কারণে মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন, তিনি তার চাদরের এক পাশ উঠিয়ে ডান বাহু বের করলেন এবং বললেন, আল্লাহ ওই ব্যক্তির প্রতি রহম করুন, যে তাদের কাছে নিজের শক্তি প্রদর্শন করবে। এরপর তিনি সাহাবিদের নির্দেশ দিলেন তিন চক্করে রমল (দ্রুত পদক্ষেপে চলা) করতে এবং দুই রুকনের মাঝে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে, যেন মুশরিকরা তাদের বলিষ্ঠতা দেখতে পায়।
নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওমরাহ শেষ করার পর, মুশরিকদের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মক্কা ছেড়ে বের হয়ে আসেন এবং জিলহজ মাসে মদিনায় পৌঁছেন।
ওএফএফ/জিকেএস