তারুণ্যের চোখে একুশের পহেলা বৈশাখ

0
0


আরেকটি বাংলা বছর মিলিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে। পান্তা-ইলিশের স্বাদ, বৈশাখী মেলার উচ্ছ্বাস, লাল-সাদা পোশাকে রঙিন প্রভাত – এসব কি আজও একই রকম প্রাণ জাগায়? নাকি ব্যস্ত জীবনে ফিকে হয়ে গেছে শৈশবের সেই আনন্দভরা বৈশাখ? সময়ের পালাবদলে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে দেখছে পহেলা বৈশাখকে? শৈশবের নির্মল উৎসববোধ আর বর্তমানের ব্যস্ত তারুণ্যের অনুভূতির সেই ফারাক জানার চেষ্টায় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন তানজিদ শুভ্র-

বৈশাখ এলেই ফিরে দেখা শৈশব
হাসান সাইফুল্লাহ
শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর

শৈশবে পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস। সকালবেলা নতুন পোশাক পরে পরিবারের সঙ্গে বৈশাখী মেলায় যাওয়া, পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশের স্বাদ নেওয়া, কোলাহলময় মেলার ভিড়ে সস্তা খেলনা কেনা-সব মিলিয়ে দিনটি ছিল নিখাদ আনন্দের। স্কুলের মাঠে বসা বৈশাখী মেলা, ঢাক-ঢোলের আওয়াজ, রঙিন কাগজে মোড়া খেলনা, লাটিম আর মুখভরা হাসিই ছিল উৎসবের আসল রং।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে বৈশাখের অনুভব। কর্মব্যস্ত জীবনে এখন বৈশাখ কেবল ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ মাত্র। পান্তা-ইলিশের ঐতিহ্য স্থান করে নিয়েছে রেস্তোরাঁর মেনুতে বা টেলিভিশনের পর্দায়। মেলার জায়গা দখল করেছে অনলাইন শপিং, আর লাল-সাদা পোশাককে প্রতিস্থাপন করেছে অফিসের ড্রেসকোড।

আজকের বৈশাখ মানে ক্যামেরার সামনে হাঁসফাঁস করে তোলা ছবি, ফেসবুকে ‘শুভ নববর্ষ’ লেখা স্ট্যাটাস, আর সাজসজ্জার এক কৃত্রিম প্রতিযোগিতা। কিন্তু মন জানে, সেই ছবিগুলোতে শৈশবের খুশির রং নেই। এখন পহেলা বৈশাখ আসে, কিন্তু মন আর শিশুর মতো লাফিয়ে ওঠে না। শহরের কোলাহলে হারিয়ে গেছে পাড়ার ঢাকির শব্দ, মেলার মুখরতা, আর সেই প্রাণখোলা হাসিগুলো।

তবুও বৈশাখ এলেই হৃদয়ে এক মধুর নস্টালজিয়া জাগে। মন অজান্তেই খুঁজে ফেরে সেই সরল আনন্দ, যেগুলো আর ফিরবে না, তবুও হারায়ও না। শৈশবের বৈশাখ হয়তো অতীত হয়ে গেছে, কিন্তু তার আবেদন আজও অমলিন, অনন্ত।

পহেলা বৈশাখের আসল সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে
মোসাঃ আফরিনা আক্তার
শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ,ঢাকা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির ইতিহাসে এক অনন্য উৎসব। বাঙালি জাতি প্রতিবছর এই দিনটিকে এক নতুন আঙ্গিকে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পহেলা বৈশাখের স্বকীয় উচ্ছ্বাস।

পহেলা বৈশাখে বাঙালির ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতির চর্চা তেমন আর দেখা মিলে না, এর পরিবর্তে কোথাও কোথাও দেখা যায় পাশ্চাত্য ট্রেন্ডের প্রভাব। যেখানে দেখা যেত গ্রামীণ মেলা ও সহজ-সরল আনন্দ, বর্তমানে তা বিকৃত হয়ে আয়োজিত হচ্ছে হাই প্রোফাইল ইভেন্ট ও ব্যয়বহুল পার্টি। গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার ইলিশ-পান্তা এখন আর দেখা মিলে না, বরং দেখা যায় মাত্রাতিরিক্ত দামি ও অপ্রয়োজনীয় বিদেশি খাবারের প্রচলন।

বাংলা বর্ষবরণের উৎসবে বাঙালির যে মানসিকতা ও আত্মিক আনন্দে ভরপুর ছিল, তা এখন অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিদেশি সংস্কৃতির চর্চা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় পহেলা বৈশাখের সহজ-সরল আনন্দ বিকৃত হয়ে দেখা মেলে ফেসবুক, সেলফি, টিকটকে। নানা ব্যস্ততার ভিড়েও বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই বর্ষবরণ উৎসব আমাদের ভুললে চলবে না।

বাংলার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। তার জন্য সবার আগে দরকার আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এই নববর্ষ উৎসব তার নিজস্ব সাজ-সজ্জাতেই টিকে থাকুক এবং এর সঙ্গে কোনো অপসংস্কৃতির সংমিশ্রণ না ঘটুক-এমনটাই প্রত্যাশা হওয়া উচিত আমাদের সবার।

রংহীন উৎসব, রঙিন স্মৃতি
শ্রী গৌরাঙ্গ উংকুর সরকার
শিক্ষার্থী, সরকারি বাঙলা কলেজ

বৈশাখ আসত পা ভরিয়ে রোদের আঁচলে। শৈশবে সে ছিল রূপকথার রাজকুমার ঝলমলে সোনালি ধুলোয় ভেসে আসা দিন, বাবার হাত ধরে মেলায় যাওয়া, কাচের চুড়ি আর বাঁশির সুরে মাতাল দুপুর। নতুন জামার গন্ধে জেগে উঠত পৃথিবীর সব ভালোবাসা। এখন বৈশাখ আসে নিঃশব্দে অফিস ফেরত ক্লান্তির মধ্যে, একজোড়া চোখে বিজ্ঞাপনের বাহারে। পান্তা-ইলিশ আজ শুধুই আয়োজন, শিকড়ের টান নয়। লাল-সাদা কাপড়ে শরীর জড়ায়, মন নয়। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সে আনন্দ, যে আনন্দে মিশে ছিল প্রকৃতি, মানুষ আর আবেগের নিখাদ সুর। তবু হৃদয়ের গহিনে এক অবচেতন কান্না বয়ে চলে যদি কোনো বৈশাখ ফেরে, পুরোনো সেই পলাশের ডালে, যেখানে সময় থেমে থাকত শুধুই বেঁচে থাকার জন্য ।

বৈশাখ স্মৃতিকাতর মনে জমিদারির ঐশ্বর্য
নুসরাত জাহান জেরিন
শিক্ষার্থী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইন কলেজ

বৈশাখ আমার জীবনে স্মৃতিকাতর জমিদারীর ঐশ্বর্যের মতোন। বৈশাখকে ঘিরে শৈশব কৈশোরের স্মৃতি রোমন্থনে নিজেকে ধনী মনে করি। প্রত্যন্ত গাঁয়ে ঐ বৈশাখের ছোঁয়ায় আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ধারায় আনন্দ জোয়ারে ভাসি।

বৈশাখ শব্দটিতে জুড়ে আছে আমার গ্রামের বাড়ি গৃহস্থি মাঠ উঠোনে ফসল তোলার উৎসব, মাটির চুলায় বড় বড় পাতিলে ধান সিদ্ধের ধোঁয়া, বাতাসে ভাসা গন্ধ, যৌথ পরিবারের হাসি আনন্দ, উচ্ছ্বাস, সেই ফসলী জমি, জমির আইল ধরে ছুটে চলা, কাল বৈশাখী ঝড়ের দাপুটে হাওয়া, টিনের চালে বৃষ্টি রিমঝিম, কাঁদা মাটিতে কাঁচা আম কুড়ানোর উল্লাস। বছর শুরুতে গ্রামের বাজারের দোকানে শুভ হালখাতার নিমন্ত্রণে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার ভিন্ন মজা।

দাদা ভাইয়ের আঙুল ধরে বৈশাখী মেলায় গিয়ে মাটির তৈরি পুতুলসহ নানা খেলনা কেনা। ভেষজ রস, নাড়ু, মোয়া, মুড়ালি, খাজা, চিড়া, দই, গুড়, বাতাসা, কারুপণ্য, কৃষিজাত দ্রব্য, কত কিছু। আমার হারানো বৈশাখ এখন শহুরে জীবনে দামী ইলিশ পান্তাভাতে তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলে না। আধুনিকতার রঙে বৈশাখের নানা রূপ সংযুক্ত হলেও মন আমার মিশে থাকে স্মৃতিকাতর হারানো জমিদারীর ঐশ্বর্যে।

কেএসকে/জিকেএস