নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও ক্ষমতায়ন একটি সমাজের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। সমাজে নারীরা প্রতিনিয়ত নানা বাধা ও বৈষম্যের সম্মুখীন হলেও তাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্বসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগ ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করতে হলে কেবল আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও বাস্তব পদক্ষেপ। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বীকৃতি ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হলে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে উঠবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস কেবল উদযাপনের দিন নয়, বরং এটি নারী অধিকার, মর্যাদা ও সমতার জন্য সচেতনতা তৈরির উপলক্ষ। নারী দিবস সামনে রেখে নারীর চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাবনা ও মতামত তুলে ধরা হলো-
তাহসীন নাওয়ার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নারী দিবস- এই দুটি শব্দ যেভাবে একটি উদযাপনকে নির্দেশ করে, সেই উদযাপনে এখন আর ঠিক খুশি হওয়া যায় না। অবশ্যই নারীদের অধিকার ও সমতার বিষয়ে এই দিনটি খুবই তাৎপর্যবহ। এই দিনটি একই সঙ্গে যেমন মনে করিয়ে দেয় যুগ যুগ ধরে সমতার পথে একেকটি পদক্ষেপের ইতিহাস, সেই সঙ্গে সামনে এগোতে হবে আরও অনেকখানি পথ- সেই লক্ষ্যও।
বর্তমানে দেশজুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা যে হারে বেড়েছে, তাতে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও তার স্বাধীন চলাচলের অধিকার রক্ষাই প্রশাসনের প্রধান শপথ হওয়া উচিত।
স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রতিটি স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে কমলে তা মোটেও কাম্য নয়। এই অংশগ্রহণ যাতে কমে না যায়, মেয়েশিশুরা যেন শিক্ষার প্রতিটি স্তর পার করে আসতে পারে, এমন শিক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। সমতা অর্জনের লক্ষ্যে দেখা স্বপ্নগুলো, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেওয়া পদক্ষেপগুলো যাতে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ না থাকে, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, দক্ষতায় দীক্ষিত এক নতুন প্রজন্ম গড়ে ওঠে যারা নিরাপদ ও স্বাধীন চলাচলের নির্ভরতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে-এটাই চাওয়া।
ওয়াহিদা পারভীন ঈশিতা
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ অপরিহার্য। এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কেবল তার ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজ ও দেশের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রয়োজন রয়েছে। বাহ্যিক বিভিন্ন উপাদান এই বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে, আবার কখনো তা বাধার কারণও হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে নারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নানান প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে আসছে।
সমাজ নারীদের একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে, যেখানে তাদের মা, বোন, স্ত্রী, শাশুড়ি বা দাদির ভূমিকায় আবদ্ধ রাখা হয়। কিন্তু এই প্রতিটি পরিচয় যদি যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে মূল্যায়ন করি, তাহলে তা সমাজের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যথায়, নারীরা সমাজে অবহেলিত ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
একটি দেশের উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান রয়েছে সমান। আজ নারীরা সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। তবু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে এবং হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের সম্মুখীন হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ (৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। দুঃখজনকভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি অপরাধীদের আরও সাহসী করে তুলছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে। নারীকে কেবল পরিবারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে, তাদের মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
একটি সমাজ তখনই প্রকৃত উন্নতি করতে পারে, যখন নারী-পুরুষ উভয়ই সমানভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক বিকাশের সুযোগ পাবে। সুতরাং, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু তাদের অধিকারের প্রশ্ন নয়, বরং একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এটাই বলা প্রয়োজন— ‘জীবন যদি রংধনু হয়, তবে নারী তার রঙের সৌন্দর্য; আর জীবনে যদি অন্ধকার নামে, তবে নারী হবে আশার আলো।’
মাহীন মোজাফফর
শিক্ষার্থী, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
নারী দিবস শুধু উদযাপনের জন্য নয়, এটি নারীর অধিকার, মর্যাদা ও সমতার জন্য সচেতনতা তৈরির দিন। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা অবদান রাখলেও, আজও তারা বৈষম্য, সহিংসতা ও নানান বাধার মুখোমুখি হন।
সমাজে নারীর অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে হলে সমান সুযোগ ও ন্যায্য পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব—সব ক্ষেত্রেই নারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। শুধু আইন নয়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে নারীদের প্রতি বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে।
নারীর জন্য চাকরির সমান সুযোগ থাকা প্রয়োজন, যাতে তারা পরিবার ও ক্যারিয়ার দুটোই সামঞ্জস্য রাখতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
নারী দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন প্রতিটি নারী নিরাপদ, স্বীকৃত ও স্বনির্ভর হতে পারে। এখন সময় এসেছে কেবল কথা নয়, বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার।
নারীর ক্ষমতায়ন মানে শুধু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়, বরং তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, প্রযুক্তিতে দক্ষতা ও সামাজিক সমর্থনই পারে নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে।
নারী দিবস কেবল একটি নির্দিষ্ট দিনের প্রতীক নয়, এটি নারীর প্রতিদিনের সংগ্রাম ও সাফল্যের স্বীকৃতি। একসঙ্গে কাজ করলে, একে অপরকে সমর্থন করলে, আমরা এমন এক ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারব যেখানে নারী ও পুরুষ সমান সুযোগ পাবে এবং সমাজ সত্যিকারের উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
ইশরাত জাহান শান্তা
শিক্ষার্থী, প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি
নারী—একটি শব্দ, যা বহন করে অসীম শক্তি, সম্ভাবনা এবং ত্যাগের গল্প। এই শব্দটি আমার কাছে একদিকে আশার, অন্যদিকে সংগ্রামের প্রতীক। নারী চাইলে পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে পারে ভালোবাসা, মেধা ও সৃজনশীলতার আলোয়, আবার সেই একই নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বদলে দিতে পারে ইতিহাসের গতিপথ। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, খেলাধুলা, চিকিৎসা, শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসা কিংবা উদ্যোক্তাবৃত্তি—প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা নিজেদের প্রতিভা ও দক্ষতার সাক্ষর রেখে চলেছেন।
আমরা সেই নারীদের সাফল্যগাথা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি, যারা সমাজের স্বীকৃতির শীর্ষে পৌঁছেছেন। কিন্তু কতজন কথা বলি সেই নারীদের নিয়ে, যারা বছরের পর বছর নিঃশব্দে একটি পরিবারের স্বপ্ন, ভালোবাসা আর যত্নের প্রদীপ জ্বালিয়ে চলেন? ঘরের প্রতিটি কোণ সাজিয়ে, ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখেন পরিবার?
ভাবুন তো, সারাদিন ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে যদি দেখেন, টেবিলে খাবার সাজানো, ঘর গোছানো, প্রতিটি জিনিস তার জায়গায়, আর বাড়ির সেই নারী আপনাকে স্নিগ্ধ হাসি উপহার দিচ্ছেন—এটাই তো সত্যিকারের শান্তি! যদি আপনার ঘর এমন পরিপাটি, সুশৃঙ্খল হয়, তাহলে বুঝতে হবে, আপনার জীবনের সৌন্দর্যের পেছনে এক নারীর অবিরাম শ্রম, মমতা আর ধৈর্য লুকিয়ে আছে।
একজন নারী যখন ঘর সামলান, সন্তান লালন করেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের যত্ন নেন, তখন সেটি নিছক কাজ নয়—এটি এক অবিরাম সাধনা। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই শ্রমের কোনো স্বীকৃতি নেই, একে পেশা হিসেবে গণ্য করা হয় না। যখন পুরুষ বাড়ির বাইরে থাকেন, তখন এক নারীই সেই ঘর এবং তার সদস্যদের সুরক্ষিত রাখেন, ভালোবাসায় আগলে রাখেন। কিন্তু এজন্য তাকে স্বীকৃতি কিংবা সম্মান কতটুকু দেওয়া হয়?
বিশ্ব নারী দিবসে আমরা শুধু কর্মক্ষেত্রে সফল নারীদের নয়, সেই অপ্রকাশিত নারীশক্তিকেও শ্রদ্ধা করি, যারা ভালোবাসা, মমতা ও আত্মত্যাগ দিয়ে একটি ঘরকে পরিণত করেন নিরাপদ আশ্রয়ে। যাদের শ্রম, স্নেহ ও ভালোবাসায় গড়ে ওঠে আমাদের সুখী সংসার, যারা নিঃশব্দে লড়ে যান প্রতিদিন—তাদের প্রতি রইলো গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। নারী দিবস শুধু কিছু অর্জন উদযাপনের দিন নয়, বরং প্রতিটি নারীর অবদানকে সম্মান জানানোরও দিন।
এসআরএস/এমএমএআর/এএসএম