‘এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই’

0
0


শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় সরকার। এতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জ্বালানি বিভাগের অনুমোদনের পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।

ফেব্রুয়ারিতে বিইআরসি কমিশন সভায় বাড়তি দামের অনুমোদন দিলেই বাড়বে গ্যাসের দাম। তবে এই মুহূর্তে গ্যাস বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতাই দেখছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন এবং কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বিগত সরকারের আমলে জ্বালানিখাতের দুর্নীতি, লুণ্ঠনের পরিমাণ নিরূপণ করে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা।

‘গরমকালে কী হবে আমরা তো চিন্তাই করতে পারছি না’

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, শিল্পে কিছুদিন আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তারপর তো এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। এখন দাম বাড়ানোর মতো কোনো যুক্তি দেখছি না। জ্বালানি উপদেষ্ট এর আগেও দাম বাড়ানোর আভাস দিয়েছিলেন। সমস্যাটা হচ্ছে যারা ইনভেস্ট করে বসে আছেন তারা তো গ্যাস পাচ্ছেন না। সংকটের কারণে নতুন করে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এখন তাদের তো সরকার বলেনি যে এই দামে তারা গ্যাস পাবে না। তারা হয়তো এই দামে গ্যাস সংযোগ নেবে না। এখন গ্যাস নিতে হলে তাদের দুই গুণ বেশি দাম দিতে হবে।

তিনি বলেন, এখন সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বিইআরসি কী বলে! পেট্রোবাংলা বা সরকার ইচ্ছা করলেই তো আর দাম বাড়াতে পারবে না। আমার যতটুকু ধারণা যে বিইআরসি বলবে যে এরকম দাম বাড়ানো সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন

দাম বাড়ার পরে শিল্পখাতে কী ধরনের আঘাত আসতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন তাদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হচ্ছে তারা তো গ্যাসই পাচ্ছে না। তারা বড় বড় সিলিন্ডার ডাবল দামে কিনে এনে ম্যানেজ করে চলছে। কেউ কেউ হয়তো ডিজেল জেনারেটর চালাচ্ছে।

সরকার ভাবছে দাম বাড়ালে সরবরাহ বাড়াতে পারবে। কিন্তু এই আশ্বাস দিয়ে এর আগেরবারও দাম বাড়ানো হয়েছিল। সরকার সেই আশ্বাস ভঙ্গ করেছে। এখন শীতকালে তো পাওয়ার সেক্টরে তেমন গ্যাসের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কিছুদিন পরে গরমকালে কী হবে আমরা তো চিন্তাই করতে পারছি না।–ড. ইজাজ

তিনি বলেন, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যাদের কাছে দুই গুণ, তিন গুণ ম্যাটার করে না। এটা কস্ট অব প্রোডাকশনে খুবই অল্প। যেমন টাইলস, স্টিল ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর গ্যাসের প্রয়োজন। আমার মনে হয় তারা এরকম ডাবল দামে ম্যানেজ করতে পারবে না। তারা হয়তো বসে যাবে। আমি শিল্প উদ্যোক্তাদের অনেক আগে সতর্ক করেছি, এনার্জি ইনটেনসিভ ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশ সারভাইভ করতে পারবে না।

দাম বাড়ানো নাকি সরবরাহ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার ভাবছে দাম বাড়ালে সরবরাহ বাড়াতে পারবে। কিন্তু এই আশ্বাস দিয়ে এর আগেরবারও দাম বাড়ানো হয়েছিল। সরকার সেই আশ্বাস ভঙ্গ করেছে। এখন শীতকালে তো পাওয়ার সেক্টরে তেমন গ্যাসের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কিছুদিন পরে গরমকালে কী হবে আমরা তো চিন্তাই করতে পারছি না। তখন পাওয়ার সেক্টরে গ্যাসের ডিমান্ড সাংঘাতিকভাবে বাড়বে। আমি ঠিক পরিষ্কার না যে সরকার সেই পরিস্থিতি সামলাবে কীভাবে।

‘এলএনজি আমদানি দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করায় পেট্রোবাংলার লোকসান হচ্ছিল। এখন সেই লোকসান কমাতেই দাম বাড়াতে চাচ্ছে সরকার।’ এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এরকম কোনো যুক্তি নেই। কারণ সরকার এলএনজি আমদানি করছে কতখানি? আমাদের তো দেশীয় গ্যাস আছে। ৮০ শতাংশ গ্যাসই রয়ে গেছে। দেশীয় গ্যাসের দাম তো কম। এখন বলা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি গ্যাস নিলে এলএনজির দাম দিতে হবে। এভাবে গ্যাসের দাম তো দুই সেক্টরে দুই রকম হতে পারে না। বরং এসব নিয়ে একটা পলিসি দরকার।

তিনি বলেন, দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়লে এলএনজি আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাহলে কারখানায় কম দামে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এখন কথা হচ্ছে গ্যাস তো আগে আমাদের আবিষ্কার করতে হবে। যতক্ষণ না পাচ্ছি ততক্ষণ তো এলএনজির ওপর নির্ভর করতেই হবে। গ্যাস আহরণের ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে হবে।

‘ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব যৌক্তক বা ন্যায্য হবে না’

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার না হলে যেমন নির্বাচন দেওয়া যাচ্ছে না। এরকম বিভিন্ন খাতে সংস্কার না করলে রাষ্ট্র সঠিক পথে আসছে না। জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়িয়ে যে লুণ্ঠন করা হয়েছে, সেটি কোথায় কখন কীভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে সেটি নির্ধারণ করে সংস্কারের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব যৌক্তক বা ন্যায্য হবে না।

জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়িয়ে যে লুণ্ঠন করা হয়েছে, কোথায় কখন কীভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে সেটি নির্ধারণ করে সংস্কারের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব যৌক্তিক বা ন্যায্য হবে না।-অধ্যাপক এম শামসুল আলম

তিনি বলেন, লুণ্ঠন করে ঘাটতি তৈরি করা হয়েছে, সেই ঘাটতি সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে আর লুণ্ঠনের অর্থ উদ্ধার করা হবে না- এটা কোনো রাষ্ট্রের দায়িত্ব হতে পারে না। বিগত সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় দলীয় লোকদের লুণ্ঠনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই সরকার তো তাদের সুরক্ষা দিতে পারে না। আগে এ কাজটি করতে হবে, এরপর দাম বাড়ানো হবে কি হবে না, হলে কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করা যাবে।

সরকার বলছে এলএনজি আমদানিতে খরচ বেশি, এজন্য দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেটি তারা বলছে। কত বেশি হচ্ছে? কেন বেশি হচ্ছে? সেটি দেখতে হবে। আমরা দাম দেবো কিন্তু আমাদের থেকে ন্যায্য দাম নেওয়া হচ্ছে কি না সেটি দেখতে হবে। স্পট মার্কেটে যখন দাম বেশি হয় তখন কেনে। এটির তো কোনো যৌক্তিকতা নেই। জি টু জি চুক্তির আওতায় কত দামে গ্যাস কেনা হয় সেটি জানানো হয় না। এসব তো সামনে আসতে হবে।

এই মুহূর্তে দাম বাড়ানো যৌক্তিক কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ভোট দিতে পারি না বলে সংস্কার হচ্ছে, আমাদের থেকে লুণ্ঠন হচ্ছে সেটিও তো বন্ধ করতে হবে। সেটি না করে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে, লুণ্ঠনের টাকা দাম বাড়িয়ে মানুষের কাছ থেকে তুলতে হবে এটি হতে পারে না। এই পদক্ষেপটাই ঠিক না। জনগণের দাবি উঠেছে, যেসব পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতগুলো তো অবজারভ করতে হবে।

এনএস/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।