ঝালকাঠিতে গত বছর একাধিক বারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় পারিবারিকভাবে শাক-সবজি ও লতা কৃষিতে আগ্রহ বাড়ছে। বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা কম থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত শাক-সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। চাষ করা শাক-সবজি ও লতা কৃষি নিয়ে এক ধরনের হতাশা প্রকাশ করছেন তারা।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাভারামচন্দ্রপুর ও নবগ্রাম ইউনিয়নের ৩৬ গ্রামে সারাবছরই বিভিন্ন সবজি আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ ছাড়া জেলার ৪ উপজেলার বাকি ৪৩৫ গ্রামে পেশাদার কৃষিজীবী আছেন অনেক। চাষিদের অর্থকরী ফসল বিভিন্ন সবজি। এ বছরও ব্যাপক সবজির চাষ হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি হয়। কিন্তু বর্তমানে সবজির বাজারদর খুবই কম। উৎপাদিত সবজির কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষিরা। পরিবহন ও শ্রমিক খরচের টাকাও উঠছে না সবজি বিক্রি করে। ক্রেতা কম থাকায় অধিকাংশ সবজিই নষ্ট হচ্ছে জমিতে। চাষিরা বলছেন, বাজারে দাম নেই। পাইকারি ব্যবসায়ীরাও আসছেন না। জমিতে নষ্ট হচ্ছে বাঁধাকপি ও ফুলকপি।
ঝালকাঠির বেশকয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে এখন বাঁধাকপি ও ফুলকপিতে ভরা। মাঠে আছে চিচিঙা, করলা, টমেটো, বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, আলু, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়াসহ পর্যাপ্ত সবজি। সবজির তুলনায় ক্রেতা কম। এতে অধিকাংশ কাঁচামাল নষ্ট হয়ে লোকসানে আছেন বিক্রেতারা। বাগড়ি বাজারের কয়েকজন সবজি বিক্রেতা জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেচাকেনা করতে হচ্ছে। বাজারে সবজির দামও কমেছে, ক্রেতার সংখ্যাও কমেছে। এতে সবজি নষ্ট হচ্ছে। লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ী ও চাষিদের।
সদর উপজেলার শিমুলেশ্বর গ্রামের সবজি চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে ফুলকপির আবাদ করতে খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। সঙ্গে আছে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ। এখন এক বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এতে ট্রাক ভাড়া ও শ্রমিক খরচের টাকা হচ্ছে না।
ফুলকপি চাষি ইদ্রিস আলী, রুহুল আমীন, জয়দেব, নারায়ণ, সামিউল আলম জানান, অনেক আশা নিয়ে ফুলকপি ও বাঁধাকপির আবাদ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছে। মাঠজুড়ে শুধু কপি দেখা যায়। একেকটি কপির ওজন হয়েছে দেড় থেকে দুই কেজি। এখনো বিক্রি করতে পারেননি। জমিতে অনেক ফুল ফুটে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে স্থানীয় বাজারে ৪-৫ টাকা পিস বিক্রি করতে হচ্ছে।
তারা জানান, ঝালকাঠি জেলা শহর ও বরিশালে পাঠিয়ে কোনোমতে ট্রাক ভাড়া হচ্ছে। ঘর থেকে শ্রমিক খরচ দিতে হচ্ছে। সার ও কীটনাশকের দোকান থেকে ধার-দেনা করে আবাদ করছেন। বিক্রির পর দেনা পরিশোধ করবেন। কিন্তু সে আশায় ভাটা পড়েছে। অনেক টাকা দেনা পরিশোধ করতে হলে সমিতি থেকে ঋণ নিতে হবে।
কৃষক সোলাইমান হোসেন বলেন, ‘বাঁধাকপি কয়েক সপ্তাহ রাখা গেলেও ফুলকপি বিক্রির উপযোগী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করতে হয়। না হলে ফুল ফুটে গেলে বিক্রির অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আমার এক বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি করতে না পারায় জমিতে নষ্ট হচ্ছে।’
সদর উপজেলার ভীমরুলী গ্রামের চাষি পারভেজ বলেন, ‘আমার ক্ষেতের প্রায় অর্ধশত লাউ বিক্রির উপযোগী হয়েছে। স্থানীয় বাজারে ক্রেতা নেই। পরিবহন খরচ না হওয়ায় বাইরের বাজারেও পাঠাতে পারছি না। অনেক লাউ পরিপক্ব হয়ে গেছে। খরচ ও শ্রম সবই বৃথা।’
পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল বাশার, আউব আলী ও জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রথম প্রথম চাহিদা অনুমান করে প্রতি বিঘা জমির বাঁধাকপি ৬০ হাজার ও ফুলকপি ৭০ হাজার টাকায় কিনে রেখেছি। এখন আর বিক্রি করতে পারছি না। ঝালকাঠি জেলা শহর ও বরিশালে পাঠানো হলেও চালান ঘুরছে না।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর জেলায় ৭ হাজার ৭০৪ হেক্টর শীতকালীন সবজি চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছরই শীত মৌসুমে ঝালকাঠি জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে শীতকালীন শাক-সবজি ও লতা কৃষির আবাদ হয়। একাধিকবার বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে অনেক ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। চাষিরা পুনরায় আবাদ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘শাক-সবজি ও লতা কৃষির অভাব দেখা দিতে পারে, এ জন্য পারিবারিকভাবেই অনেকে কৃষি কাজ করে শাক-সবজি ও লতা কৃষি উৎপাদন করেছেন। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সরবরাহ কম থাকায় চাষিরা কিছুটা দর পেয়েছেন। কিন্তু এখন সবার বাড়ির আঙিনা বা ক্ষেত-খামারে আবাদকৃত শাক-সবজি উৎপাদন হওয়ায় হঠাৎ দরপতন হয়েছে।’
এসইউ/জিকেএস