ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ৬ ব্যাংকই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পর সোমবার (৬ জানুয়ারি) এই ৬ ব্যাংকের শেয়ার শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়েছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এই ৬ ব্যাংকের মধ্যে ৩টির শেয়ারদাম কমেছে। বিপরীতে দাম বেড়েছে ১টির। আর ২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এর আগে রোববার (৫ জানুয়ারি) ৬টি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গভর্নরের বৈঠকের পর এমডিদের ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ৬ ব্যাংকের মধ্যে যেসব ব্যাংকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আছেন তাদের বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসার পর সোমবার স্বাভাবিক নিয়মেই শেয়ারবাজারে এই ৬ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার দাম কমেছে। বিপরীতে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার দাম বেড়েছে। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এক্সিম ব্যাংক
আগের কার্যদিবসের লেনদেন শেষে এক্সম ব্যাংকের শেয়ারদাম ছিল ৭ টাকা ২০ পয়সা। সোমবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারদাম দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ১০ পয়সা। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ১০ পয়সা। এতে সম্মিলিতভাবে ব্যাংকটির শেয়ারদাম কমেছে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩৪ টাকা। ৭ টাকা থেকে ৭ টাকা ২০ পয়সার মধ্যে কোম্পানিটির ৪ লাখ ৮৫ হাজার ২১৮টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
২০০৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকটি সর্বশেষ ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। তার আগের ২০২২ ও ২০২১ সালেও ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। এছাড়া ২০২০ সালে সাড়ে ৭ শতাংশ নগদ ও আড়াই শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৯ ও ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ, ২০১৭ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ এবং ২০১৬ সালে ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। অর্থাৎ ব্যাংকটি নিয়মিত বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
আগের কার্যদিবসের লেনদেন শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদাম ছিল ৫ টাকা। সোমবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারদাম দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ১০ পয়সা। এতে সম্মিলিতভাবে ব্যাংকটির শেয়ারদাম কমেছে ১০ কোটি ৩৬ লাখ ৮১ হাজার ১৬৭ টাকা। ৪ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৯০ পয়সার মধ্যে কোম্পানিটির ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ ৫৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি সর্বশেষ ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদাম ৮ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমে ৮ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ১০ পয়সা। এতে সম্মিলিতভাবে ব্যাংকটির শেয়ারদাম কমেছে ১১ কোটি ৪০ লাখ ১৫ হাজার ৫১০ টাকা। ৮ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৮ টাকা ৯০ পয়সার মধ্যে কোম্পানিটির ১১ লাখ ৮২ হাজার ৯০৩টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ ১ কোটি ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন
২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি সর্বশেষ ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। তার আগের ২০২২, ২০২১, ২০২০ ও ২০১৯ সালেও ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। এছাড়া ২০১৮ ও ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ করে বোনাস লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি।
আইসিবি ইসলামী ব্যাংক
আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদাম ২ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ১০ পয়সা। এতে সম্মেলিতভাবে ব্যাংকটির শেয়ারদাম বেড়েছে ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার ২৩০ টাকা। ২ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৩ টাকা ১০ পয়সার মধ্যে কোম্পানিটির ৩ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৬টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংক বছরের পর বছর ধরে লোকসানের মধ্যে রয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারে না ব্যাংকটি। যে কারণে পঁচা ‘জেড’ গ্রুপে স্থান হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সর্বশেষ কবে ব্যাংকটি লভ্যাংশ দিয়েছে সে সংক্রান্ত তথ্য ডিএসইর ওয়েবসাইটে নেই।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
সোমবার লেনদেন শেষে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদাম আগের দিনের মতো ৫ টাকা ৩০ পয়সা দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির শেয়ারদাম বাড়া বা কমার ঘটনা ঘটেনি। তবে কোম্পানিটির শেয়ার ৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৫ টাকা ৪০ পয়সার মধ্যে লেনদেন হয়। ব্যাংকটির ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৯৯টি শেয়ার ৬০ লাখ ৩০ হাজার টাকায় লেনদেন হয়েছে।
২০০৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি সর্বশেষ ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। তার আগ ২০২২ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০২১ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০২০ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৯, ২০১৮ ও ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি।
ইউনিয়ন ব্যাংক
সোমবার লেনদেন শেষে ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ারদাম আগের দিনের মতো ৪ টাকা ৮০ পয়সা দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির শেয়ারদাম বাড়া বা কমার ঘটনা ঘটেনি। তবে কোম্পানিটির শেয়ার ৪ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৯০ পয়সার মধ্যে লেনদেন হয়। ব্যাংকটির ৩ লাখ ৬৪ হাজার ২৫৬টি শেয়ার ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় লেনদেন হয়েছে। ২০২২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংক সর্বশেষ ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬টি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়োজিত বৈঠক শেষে গতকাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছয় ব্যাংকে আন্তর্জাতিক অডিটর নিয়োগ করা হচ্ছে। অডিটর যেন স্বাধীনভাবে অডিট কার্য পরিচালনা করতে পারে সে লক্ষ্যে অনিয়মের ঘটনার সময় যারা ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে কার্যকর করেছি, অন্যদেরও অবিলম্বে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বলেছেন গভর্নর।’
বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো এমডিদের মধ্যে রয়েছেন- ফার্স্টসিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি ওয়াশেক মোহাম্মদ আলী, এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসাইন এবং গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকের এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত।
অডিটের তালিকায় থাকা আইসিবি ইসলমিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আগেই সরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মজিবুর রহমান এমডি (প্রশাসক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর অন্য দুই ব্যাংকের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আগেই পদত্যাগ করেছেন। ব্যাংক দুটি বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে চলছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেছেন, ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, অডিট চলাকালীন তাদের এমডিদের ছুটিতে পাঠানো হবে, যেন নিরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়।
যে ৬ ব্যাংকে অডিট হচ্ছে এর মধ্যে চারটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। গত ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এমএএস/ইএ