নতুন বছরে সড়ক দুর্ঘটনাহীন জীবন চাই

0
1


নতুন বছরে কী চান? আমরা নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। যেহেতু আমরা চাইলেও নন্দলালের মতো ঘরে বসে দিন কাটাতে পারবো না, ঘরের বাইরে যেতেই হবে, তাই ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরতে চাই আমরা। এই দেশে, এই শহরের মানুষের কাছে দুর্ঘটনা যেন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঘরের বাইরে বের হলেই যেন দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে, কী অদ্ভুত নিয়ম। অপরাধী কখনো ধরা পড়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও যে শাস্তি হবে, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

একটি দুর্ঘটনা মানে একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, একটি পরিবারের মৃত্যু। বছরের পর বছর ধরে আমরা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহত হচ্ছি। শুধু মৃত্যুতো নয়, হাজার হাজার মানুষ হাত-পা হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছেন। মাথায় আঘাত পেয়ে চিরকাল শয্যাশায়ী হয়ে থাকছেন। এই জীবন থেকে আমরা মুক্তি চাই, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর হাত থেকে বাঁচতে চাই।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ’নন্দলাল’ কবিতাটি এতো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনে, তা একটু ঝালিয়ে নেয়া দরকার। কবি লিখেছেন,
”নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিশন’ হয়;
হাঁটিতে সর্প, কুক্কুর আর গাড়ি-চাপা-পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল।”

আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন এমন যে শুধু ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেও মৃত্যু হানা দিতে পারে, প্রয়োজনে কোথাও গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও অন্য গাড়ির চাকার তলায় পড়ে পিষ্ট হতে পারি। কাজে যাওয়ার সময় বা বেড়াতে বের হয়ে ইহকালের গন্তব্যে না পৌঁছে সরাসরি পরকালে পৌঁছে যেতে পারি, বর বিয়ে করতে গিয়ে কবরে চলে পারেন, এমনকি ঘরে বসে চা-নাস্তা খেতে খেতেও একটা আস্ত ট্রাক উপরে এসে হুড়মুড়িয়ে পড়তে পারে, গুড়িয়ে দিতে পারে সবকিছু।

এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হচ্ছে, ঠিক এর চারদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনার যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে সিরাজদিখান যাওয়ার পথে দেখলাম ধলেশ্বরীর টোল প্লাজার পাশে একটি গাড়ি, যেটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক মানুষ। প্রথম দর্শনে গাড়ি বলে চিনতে কষ্ট হলেও পরে বোঝা গেল এটি একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার ছিল। টোল প্লাজায় দাঁড়ানো অবস্থায় যে এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এ সবার কল্পনার বাইরে। আমাদের ভাগ্যেও এমনটি ঘটতে পারতো। হয়তো ওরাও কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিলেন, বিকেলে ফিরে আসার কথা ছিল। অথচ এতগুলো মানুষের আর ফিরে আসা হলো না। গাড়ির অবস্থাই বলে দিচ্ছিল সেখানকার একজন যাত্রীও রক্ষা পান নাই। পরে ভিডিওটি দেখে আরো অবাক হয়ে গেলাম। এভাবেও কি মৃত্যু সম্ভব?

এই যে যাত্রীবাহী বাসের চালক কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে যে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন, এটাও একটি ট্রেনিং। প্রায় প্রতিটি বেপরোয়া গাড়ির চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়েই পালিয়ে যেতে পারে। অবশ্য পরে র্যাব তাকে আটক করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত চালক বলেছেন যে সে ১০ বছর ধরে বাস, ট্রাক, পিকআপসহ নানা ধরনের গাড়ি চালিয়ে আসছেন। তবে তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ দুই বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। তিনি যে বাসটি চালাচ্ছিলেন, সেটির ফিটনেস সনদ ছিল না। ব্যাস উত্তর পাওয়া গেল। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনেই গল্পটা এক।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো ৯ হাজার ৬০ জন। গত বছর নিহতের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৬ হাজার ৫২৪ জন। এগুলো হিসাবের মধ্যে পড়েছে, এর বাইরেও আরো কিছু আছে নিশ্চয়ই। মানুষের মৃত্যু শুধু একটি সংখ্যা বাংলাদেশে, এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৬২২ জন নিহত হয়েছেন।

দেশের সড়কের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা। সড়ক দুর্ঘটনা কেন বাড়ছে, এর উত্তর হচ্ছে বেপরোয়া চলাচল, অনিয়ন্ত্রিত স্পিড, যানবাহনের বেহাল অবস্থা, চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা, ট্র্যাফিক সিস্টেমের ব্যর্থতা অর্থাৎ নিয়ম না মানলেও কাউকে সাধারণত আইনের আওতায় নেয়া হয় না এবং জনসাধারণের অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাব। লক্ষ্য করছি গত ২৫/৩০ বছরে সড়ক ও পরিবহন সিস্টেম ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে।

এত বিচিত্র ধরনের ও বিভিন্ন স্পিডের বাহন ঢাকার রাস্তায় ও মহাসড়কগুলোতে চলাচল করে যে দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এর উপর আছে চালকদের অদক্ষতা, অধৈর্য ও যানবাহনের দৈন্যদশা। এভাবে বছরের পর বছর মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে নানাধরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়, কিন্তু কোন পরিকল্পনাই কার্যকর হতে দেখি না, বরং এর উল্টোটাই হতে দেখছি।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীনে ‘বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প’ শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণে ২০২৩ এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। তবে কাজ শুরুর এক বছর পেরিয়ে গেলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি সওজ। প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন ধীরগতির কারণে সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের ঋণ থেকে ৭৫ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। (সূত্র: বণিক বার্তা)

সড়ক আইন মেনে যদি চালকেরা গাড়ি চালাতেন, তাহলে হয়তো এতো বেশি দুর্ঘটনা ঘটতো না। গতি মাপার নিয়ম মানা হয় না ঠিকমতো। হাইওয়ে পুলিশের কাছে গতি মাপার যন্ত্র রয়েছে ঠিকই কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ কোথায়? তাছাড়া চালকরা পুলিশের সামনে কম গতিতে গাড়ি চালালেও তাদের থেকে দূরে গিয়ে আবার বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। তাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের নিরাপত্তাচৌকি বসানো খুব দরকার।

দেখা গেছে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ প্রকল্প অর্ধসমাপ্ত থেকে গেছে। মহাসড়কের নিরাপত্তার মান যাচাই করে সেগুলোর রেটিং করা, নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করা, যানবাহনের মান নিয়ন্ত্রণ, স্পিড নিয়ন্ত্রণ, ট্র্যাফিক সিস্টেম পর্যবেক্ষণসহ আরো অনেকধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও, দেখা যায় বছর শেষে অর্জন নেই বললেই চলে।

বিশেষ করে চালকদের অদক্ষতা যেন দিন দিন মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে। কাউকে কোনো শাস্তি দিলে বা কোনো নিয়ম জারি করলে সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় আন্দোলন, সড়ক অবরোধ বা যানবাহন ধর্মঘট। দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা থাকলেও, বিভিন্নকারণে তা আর হয়ে ওঠেনা। চালকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরিরও কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

আমাদের সড়কগুলোতে অবাধে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো ব্যবস্থা। বিশেষ করে এক্সপ্রেসওয়েতে, সেতুর উপরে, প্রশস্ত রাস্তায় লাগামহীন যানবাহন চলে। এ ছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা এক্সপ্রেসওয়েতে সংকেত ব্যবস্থাও আধুনিক নয়, গতানুগতিক। দেখভালের ব্যবস্থাও কঠোর নয়। অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় সজাগ থাকে না। সড়কে বিশৃঙ্খলা একটি পরিচিত চিত্র বাংলাদেশে।

এলোমেলো পার্কিং, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, ফুটপাত না থাকা, ফুটপাত দখল আমাদের কমন সমস্যা। এছাড়া সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি করি আমরা, যারা পথচারী। পথচারীদের কাছে জীবনের চেয়ে সময় দামি, তারা মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হন। এনারা কোনোভাবেই পথ পারাপারে সচেতন নন। নিয়ম-কানুন তেমন কিছুই মানতে চান না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, গত দুই দিনে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার জন্য পুলিশের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা এবং সড়কের সংকেত ব্যবস্থা দায়ী। ঘন কুয়াশার সময় হাইওয়ে পুলিশ কিছু দূরে দূরে অবস্থান নিয়ে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা। তাদের উপস্থিতিই চালকদের সতর্ক হয়ে চালাতে বাধ্য করত। সেটা তারা করছেন না। আর সবচেয়ে দামি সড়কে মান্ধাতার আমলে সাইন-সংকেতব্যবস্থা রাখা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ এসব ব্যবস্থার খরচ খুব সামান্য। (সূত্র: প্রথম আলো)

সড়কে যানবাহনের গতি বিষয়ে কিছু বিধিমালা আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা হলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য গতিসীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ যতটুকু গতি হলে চালক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, সেই অনুযায়ী চালাতে হবে। কিন্তু আমাদের চালকরা এই লক্করঝক্কর মার্কা গাড়ি-বাস সবই দ্রæত গতিতে চালাতে ভালোবাসেন। অনেকেই আছেন যারা খুব দামি গাড়ি হাই স্পিডে চালাতে ভালোবাসেন এবং দুর্ঘটনা ঘটান। ঈদে-পরবে বা ছুটির দিনে বেপরোয়া গাড়ি চালনায় অনেক বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

সড়ক আইন মেনে যদি চালকেরা গাড়ি চালাতেন, তাহলে হয়তো এতো বেশি দুর্ঘটনা ঘটতো না। গতি মাপার নিয়ম মানা হয় না ঠিকমতো। হাইওয়ে পুলিশের কাছে গতি মাপার যন্ত্র রয়েছে ঠিকই কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ কোথায়? তাছাড়া চালকরা পুলিশের সামনে কম গতিতে গাড়ি চালালেও তাদের থেকে দূরে গিয়ে আবার বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। তাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের নিরাপত্তাচৌকি বসানো খুব দরকার।

এরকম কিছু নিয়ম জোরদার করে, চালকদের তা মানতে বাধ্য করা হলে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেকটাই হ্রাস পাবে। সেইসাথে নাগরিকদের শেখাতে হবে রাস্তায় চলাচলের বেসিক কিছু নিয়ম। বিনাকারণেও যে মরে যাওয়া যায়, বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যু এর প্রমাণ। নতুন বছরে যেন মানুষকে প্রতিদিন যানবাহনের চাকার নিচে পড়ে মরতে না হয়, নতুন বছরে এটুকুই চাই।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম