১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাদিবস হিসেবে স্বীকৃত। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে-এই হত্যাযজ্ঞ কোনো দিবসকেন্দ্রিক ছিল না। ২৫ মার্চ এর শুরু। ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। আরও একটা বিষয় আমাদের সামনে আসে,রাও ফরমান আলী ও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফনেটন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নির্দেশনা ও নীলনকশা অনুযায়ী এই ঘৃণ্যতম এবং নৃশংসতম হতাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। সেখানেও সীমিতকরণ স্পষ্ট হয়। যেমনি নীলনকশা বাস্তবায়নকারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেমন রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে উল্লেখিত নামের তালিকার কথা বলা হয়। সেখানে সামান্য কিছু বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়,যাদের অধিকাংশকেই হত্যা করা হয়েছে। খুবই সামান্য কয়েকজন বেঁচে গিয়েছিলেন অলৌকিকভাবে। এই নামের তালিকা বিশ্লেষণ করে হয়তো বলা যায়, তালিকাভুক্তদের প্রায় সবাই যখন প্রাণ হারিয়েছেন তাই বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বুঝি এটিই একমাত্র। স্পষ্টত প্রমাণ হয়- রাও ফরমান আলীর তালিকায় শহিদদের সামান্য অংশের নাম ভুক্ত আছে। বাকি প্রায় দেড় হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যা কোনো নির্দিষ্ট একটি তালিকা ধরে করা হয়নি। সেগুলো অন্য কারো পরিকল্পনা কিংবা অন্য কারো প্রণীত তালিকা অনুযায়ী করা হয়েছে। অর্থাৎ সব হত্যাকাণ্ডের তালিকা প্রণয়ন রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে হয়নি।
আরও একটি কথা-ইতিহাস বলে, বুদ্ধিজীবী হত্যা কার্যকর করেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্র সংঘ (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবির) এর নেতাদের সমন্বয়ে তৈরি বদর বাহিনীর মাধ্যমে। আর এই বদর বাহিনীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে দুই ঘাতক যথাক্রমে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান-কে দোষী সাব্যস্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। তাদের মধ্যে মি. মুঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অপারেশন ইন-চার্জ এবং মি. আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। অভিযুক্তরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। এখানেও সেই একই কথা-ঢাকা শহরে দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পেছনে তাদের সম্পৃক্ততা আদালতে প্রমাণ হয়েছে। তাইলে প্রায় দেড় হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করল কারা?
এখানে আমাদের তাকাতে হয় লেফনেটন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নীলনকশার দিকে। রাও ফরমান আলী স্বীকার না করলেও তার তালিকা থেকে প্রমাণ হয়, তিনি বুদ্ধিজীবীদের নির্দিষ্ট করে হত্যাকারী দুইজনকে নির্দেশ দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অথচ রাও ফরমান আলী গণহত্যা হয়েছে বলেই স্বীকার করেননি। এতেই বোঝা যায়,তিনি সত্যকেই অস্বীকার করেছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে অপারেশন সার্চলাইট চলাকালে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে হত্যা করা হলো কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক জিসি দেবসহ কয়েকজনকে হত্যা করা হলো তখন কিন্তু বদর বাহিনী গঠন হয়নি। কিংবা ঢাকার বাইরে তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ ছিল না।
যেহেতু ২৫ মার্চ এর আগে বদর বাহিনী গঠন হয়নি তাই ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে বদর বাহিনী গঠন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেই কাজটি বদর বাহিনীর বাইরের কেউ ঘটিয়েছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তালিকা কিংবা স্থানীয় তালিকা দুটোরই অস্তিত্ব প্রমাণ হয়। সেক্ষেত্রে আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নীলনকশাকে মূল নির্দেশনা হিসেবে গণ্য করতে হবে। সেই অনুযায়ী বদর বাহিনীর ঢাকায় অবস্থানরতদের পাশাপাশি স্থানীয় বদর বাহিনীর নেতাদের সংশ্লিষ্টতা বোঝা যায়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে ১৭ বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে বিচার হয়েছে। যাদের মধ্যে মাত্র দুইজন অপরাধী যথাক্রমে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে শাস্তি প্রদান করা হয়। তাও পলাতক থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আসা রায় কার্যকর হয়নি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, প্রায় দেড় হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হলেও মাত্র ১৭জনের হত্যার বিচার হয়েছে প্রায় সবই, এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। ঢাকা শহরে দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা জানা যায়। সেখানে মাত্র ১৭জনের হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে,সেই সুবাদে বলা যায়, প্রায় পুরো অপরাধই এখনও বিচারবহির্ভুত রয়ে গেছে।
ঢাকা শহরের যখন এই হাল, সহজেই পুরো দেশের অবস্থা অনুমান করা যায়। মঈনুদ্দীন আশরাফুজ্জামান এর মতো আরও যারা হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিলো তাদের চিহ্নিত করাও হয়নি এই পর্যন্ত। সুতরাং স্পষ্টত প্রতিয়মান হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণতর।
প্রতিটি জেলায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। যেমন কুমিল্লারই একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। নজরুল্ অ্যাভিনিউর অ্যডভোকেট যতীন ভদ্রকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেলো পাকিস্তানি সৈনিকেরা। কুমিল্লার বিখ্যাত উকিল ছিলেন তিনি। যতীন্দ্রকুমার ভদ্রের সামনেই তার দুই ছেলে ডাক্তার কাজল ভদ্র ও রতন ভদ্রকে গুলি করে। দশম শ্রেণির ছাত্র রতনকুমার ভদ্র ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। ডাক্তার কাজল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও জীবিত ছিলেন। পাষণ্ড পাকিস্তানি বাহিনী যতীনবাবুকে দিয়ে গুলিবিদ্ধ দুই ছেলেকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। চোখ বেঁধে যতীনবাবুকে নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে স্কোয়াশরুমে বন্দী করে সেখানে অমানবিক নির্যাতন করে। এদিকে সেনানিবাসে যাওয়ার পথে রতন ও কাজলকে ওরা রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। ভোরবেলা শহরের মেথরদের একজন ভ্যান গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় তাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। কুমিল্লা হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন কাজলের শিক্ষক।ছাত্রকে দ্রুত তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং গোপনীয়তাও রক্ষা করেন। কিন্তু সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে হাসপাতালের বিছানায় ডাক্তার কাজলের বুকে পিস্তলের গুলি ছুড়ে হত্যা করে।
এই ঘটনার বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে-যতীন্দ্র ভদ্র কুমিল্লার বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন ,তার ছেলে একজন চিকিৎসক এই তথ্য দিয়েছে কে? শুধু তাই নয় ডাক্তার কাজল চিকিৎসাধীন আছেন হাসপাতালে সেই খবরও সেনাবাহিনী কোথা থেকে পেলো। অবশ্যই কুমিল্লাতেও বদরবাহিনীর পূর্বসুরীরা ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর গত হলেও আজ পর্যন্ত মানুষ জানে শুধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কারা যতীন্দ্র ভদ্র .ডাক্তার কাজল ভদ্রই নয়,কুমিল্লার অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো অ্যাডভোকেট প্রসন্ন কুমার ভৌমিককেও নৃশংসভাবে খুন করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের কুশিলবদের আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যেমনি এত বছর পরও প্রায় দেড়হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার কুশিলবদের নাম অজানাই রয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওই শহিদদের উত্তরাধিকারী বর্তমান গবেষকদেরও তৎপরতা চোখে পড়ে না।
এমতাবস্থায় স্পষ্ট বলা যায়,আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘটনা এবং জাতির চরম দুর্ভাগ্যজনক একটি অধ্যায় অস্পষ্টই রয়ে গেছে। স্পষ্ট করার কোনো উদ্যোগও নেই। এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে গবেষণা আরও কমে গেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে যেন অজানা বিষয়গুলো উদঘাটন হয় সেদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করুক এটুকু প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। বরাবরের মতো এবারও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাও। সঙ্গত কারণে প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকতে পারে তাঁর কাছে।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।
এইচআর/এএসএম