চলতি বছর বিশ্বের ৫৩টি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ১০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে শুধু ব্রাজিলেই এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ১৬৯ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৮১৫ জনের। মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৬ শতাংশ।
সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে ব্রাজিল থাকলেও মৃত্যুহারে শীর্ষে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৫১৭ এবং শনাক্ত ৯৫ হাজার ৭০ জন। মৃত্যুহার ০ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১৮৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। সেই হিসাবে ব্রাজিলের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ৯ গুণ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), প্যান আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা যায়।
গ্রামাঞ্চলে কাঠামো রয়েছে কিন্তু সরঞ্জাম ও জনবল নেই। শহরাঞ্চলের বড় বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরঞ্জাম ও জনবল থাকলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো নেই। এই চক্করে পড়ে ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ রোগী সেবাবঞ্চিত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে।- আইইডিসিআর পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন
ইসিডিসির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে বরাবরের মতো এবছরও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে এমন ১০টি দেশের মধ্যে সাতটিই দক্ষিণ আমেরিকার। এর মধ্যে আছে ব্রাজিল, পেরু, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও কলম্বিয়া।
দেশে মৃত্যুহার কেন বেশি জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে কাঠামো রয়েছে কিন্তু সরঞ্জাম ও জনবল নেই। শহরাঞ্চলের বড় বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরঞ্জাম ও জনবল থাকলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো নেই। এই চক্করে পড়ে ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ রোগী সেবাবঞ্চিত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ। যারা ধনী তাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন মেনে চিকিৎসা হচ্ছে কি না এবং সেটিও তদারকি হচ্ছে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। রোগীর ভিড় হাসপাতালের মেঝে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় বিকেন্দ্রীকরণ চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে স্তরভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা। তাহলে মৃত্যু কমবে।’
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর মৌসুম মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর মৌসুম আরও প্রলম্বিত হচ্ছে। ডিসেম্বরে শীতের মধ্যেও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে, তবে জানুয়ারির মাঝামাঝি সংক্রমণ কমে আসার পাশাপাশি মৃত্যুও কমে আসবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা তার প্রজনন এবং বসবাসের জন্য নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি, তবে জরুরি গবেষণা প্রয়োজন।- কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার
তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা তার প্রজনন এবং বসবাসের জন্য নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি, তবে জরুরি গবেষণা প্রয়োজন।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন,
আমাদের তুলনায় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ পাঁচ গুণ বেশি। তবে এসব দেশে মৃত্যুর হার খুবই কম। যদিও সেখানে জনসংখ্যা কম। চিকিৎসাসেবা ভালো। আমাদের দেশে জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। উল্টো প্যারাসিটামল খাই। শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ না হলে অনেকে হাসপাতালেই যায় না। ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।’
মৃত্যুহারে শীর্ষ দেশগুলোর পরিস্থিতি
ব্রাজিলের পর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি। ইসিডিসির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এবছর ৫ লাখ ৮০ হাজার ২০০ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ৪০৮ জন। মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৭ শতাংশ।
মেক্সিকোতে ৫ লাখ ২ হাজার ৭২৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ২৬২ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৫ শতাংশ। কলম্বিয়ায় তিন লাখ এক হাজার ৪২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ১৯৮ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৬ শতাংশ।
পেরুতে মৃত্যুর সংখ্যা কলম্বিয়ার চেয়ে বেশি। দেশটিতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ২৫২ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৯ শতাংশ। এছাড়া প্যারাগুয়েতে ২ লাখ ৯১ হাজার ৮২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ১২৮ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৪ শতাংশ।
এএএম/এএসএ/জেআইএম