জাল সনদে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি, ৫৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে উধাও

0
1


ভুয়া পরিচয়পত্র ও জাল সনদে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিলেট অফিসে চাকরি করেছেন ১৪ বছর। হেলপার টু প্লাম্বার থেকে হেলপার টু প্লাম্বার-প্রথম মান পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন। ভোগ করেছেন ব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা। চাকরিরত অবস্থায় গৃহনির্মাণ করতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। যার সুদসহ বর্তমানে ব্যাংকের কাছে দেনা ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়া, তার ওপর মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে গত বছরের ৬ জুলাই থেকে লাপাত্তা ওই ব্যাংক কর্মচারী। চাকরিতে যোগদানের সময় দাখিল করা তথ্য অনুসারে অভিযুক্ত ওই ব্যাংক কর্মচারীর নাম মো. ফারুক মিয়া। তিনি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার গান্দিনা গ্রামের মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে।

কিন্তু কর্মস্থলে অনুপস্থিত এবং ঋণের কিস্তি ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ফারুক মিয়ার অন্য পরিচয় পেয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ফারুক মিয়ার প্রকৃত নাম মিনহাজ মিয়া। তিনি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল থানার উত্তরপাড়া বালিয়া গ্রামের আব্দুল জলিল মিয়ার ছেলে।

এ ঘটনায় শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) সিলেট কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলজার হোসেন। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দাখিল করেন তিনি।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিলেটের একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে মজুরিভিত্তিক (কাজ নেই মজুরি নেই) একজন হেলপার-টু- প্লাম্বার নিয়োগের নিমিত্তে প্যানেল প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশি নাগরিকদের থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এরপর বিজ্ঞপ্তির বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেন মো. ফারুক মিয়া। পরে তিনি নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন যুগ্ম ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) মো. নুরুল ইসলামের সই করা ফারুক মিয়ার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় নিয়োগপত্র পাঠানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ মে হেলপার-টু-প্লাম্বার পদে যোগদান করেন তিনি।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, নিয়োগের সময় ফারুক মিয়া ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের ২০০৯ সালে এসএসসি সনদ দাখিল করেন। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর-২৪১২৪৩/২০০৬। এটি বাংড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সত্যায়িত করা ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট অফিসের ২০১৮ সালের ১২ জুন কর্মচারী নির্দেশে (নম্বর ৯১/২০১৮) ফারুক মিয়াকে নিয়মিত পদে নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং চাকরিবিধি অনুযায়ী পুলিশ প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে তাকে স্থায়ী করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়, চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর মো. ফারুক মিয়া গৃহনির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই কিস্তিতে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। এরপর ২০২৩ সালের ৬ জুন থেকে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তার অনুপস্থিতির কারণ ও ঋণের কিস্তি ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফারুক মিয়ার নামীয় জমি ক্রয়কালে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ভুয়া ও অস্তিত্বহীন।

পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইকালে দেখা যায় মো. ফারুক মিয়ার প্রকৃত নাম মিনহাজ মিয়া। তিনি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়া বালিয়া গ্রামের মো. আব্দুল জলিল মিয়ার ছেলে। ফারুক মিয়া চাকরিতে যোগদানের সময় ভুয়া সনদ, ভুল তথ্য ও কাগজপত্র দাখিল করে প্রতারণা এবং জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেছেন। তিনি ভুয়া শিক্ষাসনদ ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ফারুক মিয়া বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট অফিসের প্রকৌশল বিভাগে পদোন্নতি পেয়ে হেলপার-টু-প্লাম্বার প্রথম মান পদে কর্মরত থাকাবস্থায় গত বছরের ৬ জুন থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় ব্যাংকের সংস্থাপন শাখা থেকে পত্র পাঠানো হয়। কিন্তু ‘প্রাপক অন্যত্র চলিয়া গিয়াছে তাই ফেরত’ মর্মে পত্র ফেরত আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. ফারুক মিয়া টাঙ্গাইলের কালিহাতী গান্দিনা গ্রামের মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে এবং মিনহাজ মিয়া টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল মিয়ার ছেলে। ফারুক মিয়াকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তার শিক্ষাসনদ সংগ্রহ করেছিলেন মিনহাজ মিয়া। এরপর ফারুকের নামে নিজেই চাকরি করতে থাকেন। এদিকে প্রকৃত ফারুক মিয়া তার চাকরি না হওয়ায় (জানতেন না মিনহাজ তার নামে চাকরি করছে) প্রবাসে চলে যান।

এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেওয়া মিনহাজ মিয়ার মামা সাইফুল ইসলাম মিয়াও বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের প্রকৌশল শাখায় কর্মরত ছিলেন। মূলত তিনিই তার ভাগনে মিনহাজকে ফারুক মিয়া নামে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের কর্মকর্তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। সে সূত্র ধরেই ফারুকের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পান মিনহাজ। এ ঘটনার পর সাইফুল ইসলাম মিয়াকেও ব্যাংক থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে মিনহাজ মিয়ার মামা সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি ঘটনাটি জানতেন না। মিনহাজের সার্টিফিকেটে কিছু ভুল ছিল। তার নাম মিনহাজ আর স্কুলের সার্টিফিকেটে ছিল ফারুক।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি সিলেটে ২০০১ সাল থেকে চাকরি করছি। আর সে চাকরি নিয়েছে ২০১১ সালে। আমি ওর বিষয়ে খুব বেশি জানতাম না। তার ডাক নাম ছিল মিনহাজ। সার্টিফিকেটে ছিল ফারুক। এই বিষয়টা সে আমাকেও বলেনি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলজার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমি অভিযোগ করেছি, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কথা বলতে পারবো না। যদি কিছু জানতে হয়, তাহলে ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিয়াউল হক জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আহমেদ জামিল/জেডএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।