বাংলাদেশকে ডিস্টার্ব করার কাজে দমছে না ভারত। দমও নিচ্ছে না। নমুনা বলছে, দেশটির এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত একদম পাকা। স্বস্তি দেবে না বাংলাদেশকে। কোনো না কোনো ইস্যুতে প্রতিবন্ধকতা পাকাতেই থাকবে। পারলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পাকানোর চেষ্টাও করবে। ড. ইউনূসের সরকারকে ব্যর্থ করার যতো আয়োজন আছে সবই করবে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কয়েক মার্কিনি এরইমধ্যে একাট্টা হয়েছে। জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর তারা সেই অভিযাত্রায় নামবে। এ সংক্রান্ত হোম ওয়ার্ক শেষ তাদের।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন জনগোষ্ঠীর প্রভাবশালী নেতা চিকিৎসক ভরত বড়াই তা আরেকটু পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বার্তাসংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভরত বড়াই ‘বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর দমন–পীড়নের কথা নির্বাচনের আগেই ট্রাম্পকে দিয়ে বলাতে পারার যারপরনাই স্বস্তি তার। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে গোলমাল বাঁধানোর আশাও দেখছেন ভরত বড়াই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের এমন নিদারুণ পতন ও পলায়ন ভারতের কাছে ছিল কল্পনা বা দুঃসপ্নেরও বাইরে। সেই জ্বালা মেটাতে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি ব্যর্থরাষ্ট্র প্রমাণ করার বিশাল দায়িত্ব ভারতের কাঁধে।
এ বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশ দূরত্ব ক্রমশই বাড়ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দু’দেশের স্নায়ু দূরত্ব জ্যামিতিক গতিতে বাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের তিক্ত-কঠিন কথায় তা আরো পরিষ্কার। এক অনুষ্ঠানে ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের চারপাশে বন্ধুভাবাপন্ন দেশ নেই। তাদের সব সময় চেষ্টা থাকে বাংলাদেশকে হেয় করা, একটা ঘটনা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখা, এটা নিয়ে ষড়যন্ত্র করা। আর প্রমাণিত বিষয় হচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মেল বসেছে। গুজব-বিষোদগার তো আছেই।
গুজব-উত্তেজনা ছড়ানোর বিষয়ে অক্লান্ত খাটছে মোদি সরকারের একনিষ্ঠ ভারতীয় মিডিয়াগুলো। প্রায় প্রতিদিনই তাদের কোনো না আয়োজন থাকছে বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর নরেন্দ্র মোদি এবং তার সরকার ও দলের কয়েক ব্যক্তি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করা হচ্ছে বলে একের পর এক বিবৃতি দিয়ে আসছেন, যা শেখ হাসিনার কথারই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের দিক থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হলেও ভারত এ অবস্থা থেকে সরছে না। কোনো সীমা টানছে না। যার মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিয়েছে এটি তাদের এজেন্ডা। সেইদৃষ্টে লাগাতার বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে ভারত।
পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ভেরিফাইড পেইজ থেকেও চালানো হচ্ছে নানা প্রপাগান্ডা। পুরনো এবং ভিন্ন জায়গার ছবি প্রকাশ করে দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় উসকানি। কফি শপকে মন্দির বানিয়ে, ছাত্রলীগের নেত্রীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে হিন্দু ছাত্রীর ওপর অত্যাচারের ছবি হিসেবে চালানো হচ্ছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ইকোনোমিক টাইমস এক প্রতিবেদনে বাংলাদশের ছাত্র বিক্ষোভের পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও চীনের হাত ছিল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ’বাংলাদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন’ এমন শিরোনামে প্রতিবেদন করতে ছাড়েনি ইন্ডিয়া টুডে। শেখ হাসিনা পলায়ন করার পর ভারতে অবস্থান করছেন এবং সেখানে থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করছেন তা ফোনালাপ এবং ইন্ডিয়া টুডে-এর প্রতিবেদন থেকে বোধগম্য। কোনো বিশ্লেষক বলতে চান, ভারত যত বেশি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দেবে ততবেশি এই সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপ বুমেরাং হয়ে ফিরে যাবে।
নিজ দেশে, আশেপাশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের শাসক দলটি মারাত্মক কোনঠাসা। সুবিধা করতে পারছে না কোনোদিকেই। বাংলাদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য ৫ আগস্ট বরবাদ হয়ে গেছে। নেপাল, মালদ্বীপ, ভূটান, শ্রিলঙ্কাসহ আশপাশে খবরদারি ফলাতে পারছে না। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর ১১ তারিখে পেন্টাগনে হামলা এবং নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর মুসলিম দেশগুলোকে যখন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী তকমা দেয় স্নায়ু যুদ্ধে পরাজিত ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপকে সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নতুন স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ভারতের হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেমে আসে আরো বিপর্যয়। ভারত তখন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনে তা এখন এনেছে কানাডার বিরুদ্ধে। যা অনেকটা ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ প্রবাদের মতো।
আশপাশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কুলাতে না পেরে ভারতের অবশিষ্ট জায়গা বলতে গেলে কেবল বাংলাদেশই। সেই টার্গেটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ–আন্দোলন এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ভারত এবং দেশটির সংবাদমাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা, গুজব ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে। এখানে ইসলামপন্থী জঙ্গি, পাকিস্তানি ও পশ্চিমা শক্তির উত্থান ঘটেছে বলে অপতথ্য ছড়িয়েই যাচ্ছে।
গুজব ও ষড়যন্ত্র পার্বত্যাঞ্চল থেকে সমতল কোনো জায়গাই বাদ দিচ্ছে না। আর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে রীতিমত নাটক বানাচ্ছে। অথচ বাস্তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সেগুলোকে প্রচার করছে উল্টোভাবে। যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে অস্থিরতা পাকানো, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করা এবং দুদেশের সম্পর্ক অপ্রয়োজনীয় টানাপোড়েনে নিয়ে যাওয়া।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম