আমি যখনই সময় পাই, তখন দেশের কোলে ও বিদেশের প্রান্তরে ছুটে যাই। বহুবার নরওয়ে ভ্রমণ করেছি, কিন্তু সেদিনের ভ্রমণে আমার হৃদয়ে বাংলাদেশের অদ্ভুত এক আলোড়ন অনুভব হয়েছিল। এই গল্পটি কেবল ভ্রমণের সাধারণ বিবরণ নয়; এটি প্রেম, প্রকৃতি এবং দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে এক গভীর মানবিক সংযোগের কাহিনি। নরওয়ে ও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একে অপরের থেকে ভিন্ন, কিন্তু তাদের অন্তর্নিহিত শোভা ও আবেদন আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে।
আমি, রহমান মৃধা, একজন সুইডিশ-বাংলাদেশি নাগরিক। আমার জীবন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে, যেখানে শৈশবের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা জড়িয়ে রয়েছে। পুকুরপাড়ে বসে সূর্যাস্তের রঙিন মায়া দেখা, সবুজ মাঠে দৌড়ানো, আর বাতাসে মিশে থাকা ফুলের গন্ধ—এই মুহূর্তগুলো আমার আত্মার শেকড়ে সুর বুনেছে। প্রকৃতি সবসময় আমার জীবনে এক প্রেমিকের মতো স্থান করে নিয়েছে, যা আমাকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভ্রমণ করতে ও সেই সৌন্দর্য ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
একদিন, নরওয়ের একটি বিখ্যাত প্রকৃতি প্রদর্শনীতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ পেলাম। উত্তরের এই দেশটি তার হিমশীতল সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। সেখানে দেখলাম উজ্জ্বল লাল কাঠের ঘর, স্ফটিক স্বচ্ছ লেক, আর বরফে ঢাকা পাহাড়ের অসাধারণ দৃশ্য। ওই অপরূপ শ্বেতপাথরের সৌন্দর্য আমার ক্যামেরায় ধরা পড়ে, যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। তবে সেই মন্ত্রমুগ্ধকর দৃশ্য আমাকে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে গেলো বাংলাদেশের মাটিতে—যেখানে সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত গ্রাম আর নারকেল গাছের ছায়ায় পুকুরপাড়ের স্নিগ্ধতা আমার হৃদয়ে উকি দেয়।
নরওয়ের অপরূপ প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে, আমার মন বারবার বাংলাদেশকে খুঁজতে শুরু করলো। মনে হলো, আমি যেন আবার সেই ছোট্ট ছেলেটি, পুকুরপাড়ে বসে নারকেল গাছের ছায়ায় স্বপ্ন বুনছি। সেই শান্ত বিকেল, যেখানে পানির ঢেউগুলো হাওয়ার মৃদু সুরে কাঁপে, আমাকে নিয়ে যায় মনের গভীরতম কোণে। নরওয়ের তুষারাবৃত পরিবেশ আর বাংলাদেশের সবুজে মোড়া শান্ত গ্রামের মাঝে যেন একটি অনির্বচনীয় সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই ক্ষণে আমি বুঝতে পারি, প্রকৃতি কেবল তার সৌন্দর্য দিয়েই নয় বরং তার গভীর প্রেম ও স্নেহ দিয়ে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
সেদিন, নরওয়ের পাহাড়ের পাদদেশে হাঁটতে হাঁটতে আমার দেখা হয় রূপার সঙ্গে। রূপা, নরওয়ের এক ছোট্ট গ্রামের মেয়ে, যার চোখে ছিল সেদিন প্রকৃতির ভালোবাসার ঝিলিক। তার কণ্ঠে নরওয়ের ভাষা যেন আমার হৃদয়ে গানের সুরের মতো ধ্বনিত হলো, হয়তো বয়স কম, তবে যৌবনের ঢেউয়ের মতো। আমি প্রথমবারের মতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তার কণ্ঠে প্রকৃতির পথে হাঁটতে গিয়ে গুনগুনিয়ে গানের সুর শুনতে পাই—সেই সুর যা আমার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। মুহূর্তে ফিরে যাই আমার গ্রামের বাঁশির সুরে ভরা সন্ধ্যায়। সেদিন, আমি অনুভব করি যে প্রকৃতি ও সঙ্গীতের প্রেম ভাষার বাধা মানে না, বরং তা হৃদয়ের গভীরে একসঙ্গে গাঁথা থাকে।
আমাদের মাঝে প্রথমে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, প্রকৃতির প্রতি আমাদের অভিন্ন প্রেম তা দূর করে দিয়েছিল। রূপা তার শৈশবের গল্প বলে, বরফে মোড়া পাহাড় আর হিমবাহের প্রেমের কথা। আর আমি শোনাই বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশের কথা, যেখানে সবুজের মাঝে শিশির বিন্দুর মতো ছোট ছোট আনন্দ লুকিয়ে থাকে। আমরা বুঝতে পারি, প্রকৃতি ও ভালোবাসার অনুভূতি সর্বজনীন; এর গভীরতা সীমানার ঊর্ধ্বে।
আমার ও রূপার সম্পর্ক এক পর্যায়ে এসে এক অনন্য বন্ধনে পরিণত হয়—এটি কেবল দুটি মানুষের মিলন নয় বরং দুটি সংস্কৃতির মেলবন্ধন। যখন আমি নরওয়ে ছাড়ি, আমার হৃদয়ে রূপার গানের সুর আর সেই লাল কাঠের ঘরগুলোর স্মৃতি রয়ে যায়। সুইডেনে ফিরে, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে সেই সুর শুনি এবং বাংলাদেশের নবগঙ্গার মায়ায় ডুবে যাই। দুই দেশের প্রকৃতির ভিন্নতা আমার হৃদয়ে এক প্রশান্তি আনে, যা আমাকে প্রকৃতির প্রেমের গভীরতা নতুন করে বুঝতে শেখায়।
সে বহু বছর আগের কথা।
ভ্রমণে নরওয়ে: হৃদয়ে বাংলাদেশ, এটি কেবল একটি প্রেমের গল্প নয়; এটি প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং হৃদয়ের মাঝে গড়ে ওঠা এক অপূর্ব সেতুবন্ধন। নরওয়ের বরফে মোড়া পাহাড় ও লাল কাঠের ঘর এবং বাংলাদেশের সবুজে মোড়া পুকুরপাড়ে নারকেল গাছের ছায়া আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির ভাষা সর্বত্র এক। এটি আমাদের সবার মাঝে গভীর প্রেম, শান্তি এবং শিকড়ের অনুভূতি তৈরি করতে সক্ষম। আমি সময় পেলেই প্রকৃতির মাঝে ডুব দিতে যাই, আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে বাল্টিক সাগরের পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, কখনও পাহাড়ের পথ, কখনও কৃষিখাতে, যেখানে রয়েছে ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। মাঝে মাঝে তাকে গল্পের ছলে জসিমউদ্দিনের মতো নিমন্ত্রণ করি আর বলি—‘গাছের ছায়ায় বনের লতায়, মোর শিশুকাল, লুকায়েছে হায়! আজিকে সে-সব সরায়ে খুঁজিয়া লইব তায়, যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।’
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন (rahman.mridha@gmail.)
এমআরএম/জিকেএস
স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা
পাঠানোর ঠিকানা –
[email protected]