সরকারি হাসপাতালে একবার ইসিজি করতে সরকার নির্ধারিত ৮০ টাকা ফি দিতে হয় রোগীকে। সরকারি রসিদে সেই ফি আদায়ে সার্বক্ষণিক কক্ষে নিয়োজিত থাকেন একজন আউটসোর্সিংয়ের কর্মী। তবে গত দুই মাস ধরে রসিদ বহির্ভূতভাবে সরকার নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে ২৫০ শয্যা নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে। এভাবে প্রতিমাসে অন্তত আড়াই লাখ টাকা হরিলুট করছে হাসপাতালের সক্রিয় আউটসোর্সিংয়ের একটি সিন্ডিকেট।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ইসিজি কক্ষে মাস্ক পরিহিত একজন নারী কর্মচারী। ওই সময় পাঁচজন রোগী ইসিজি করার পর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেও তাদের কারোর হাতেই রসিদ দেখা যায়নি।
একপর্যায়ে সত্তরোর্ধ্ব এ বৃদ্ধাকে (নানি) সঙ্গে নিয়ে ইসিজি কক্ষে প্রবেশ করেন নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রাম থেকে আসা নাহিদ হোসেন। মাস্ক পরিহিত ওই কর্মচারী ইসিজি শেষে তাদের কাছ থেকে রসিদ বহির্ভূতভাবে ১৬০ টাকা নেন। তাৎক্ষণিকভাবে ইসিজি কক্ষে প্রবেশ করে ওই নারীর পরিচয় জানতে চাইলে নিজেকে আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দেন।
রসিদ বহির্ভূতভাবে টাকা আদায়ের কারণ জানতে চাইলে মৌসুমী আক্তার নামের ওই নারী বলেন, ‘যারা আসছেন প্রত্যেকেই সংকটাপন্ন রোগী। তাই ইচ্ছে থাকলেও বেশ কয়েকজনকে রসিদ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কেউ রসিদ চাইলে তাদের অবশ্যই দেওয়া হবে।’
সকাল থেকে আদৌ কোনো রোগীকে ইসিজি পরীক্ষার রসিদ দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মৌসুমী আক্তার এ বিষয়ে ইসিজি ইউনিটের ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেন।
এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর ইসিজি কক্ষে একে একে পাঁচটি রসিদ কেটে সাইডে সরিয়ে রাখতে দেখা যায় মাস্ক পরিহিত আউটসোর্সিং কর্মচারী মৌসুমী আক্তারকে। একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে ইসিজি ইউনিটে ডেকে নেন ইনচার্জ মোমোকে। সেখানে প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের সতর্ক করে দেন মোমো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেনারেল হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর ইসিজি ইউনিটের দায়িত্ব পান আরাফাত হোসেন লেমন নামের আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত এক কর্মচারী। এরপরই লেমন সেখানে গড়ে তোলেন একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট। লেমনের হয়ে সেখানে মৌসুমী ও জান্নাত নামে আরও দুজন আউটসোর্সিং কর্মচারী রসিদ বহির্ভূত টাকা আদায় করেন।
জরুরি বিভাগে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১০০ জন রোগীর থেকে ইসিজি পরীক্ষায় রসিদ বহির্ভূত টাকা আদায় করে এ সিন্ডিকেট। সেই হিসেবে প্রতিমাসে কমপক্ষে আড়াই লাখ টাকা হরিলুট হচ্ছে ইসিজি পরীক্ষা থেকেই।
হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে কথা হয় বদলগাছী উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রাম থেকে আসা কৃষক আবির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, বেলা ১১টায় হৃদরোগে আক্রান্ত স্ত্রী মলি বেগমকে জরুরি বিভাগে এনেছিলেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকের পরামর্শে ইসিজি করিয়েছেন। রসিদ ছাড়াই তার থেকে ১৬০ টাকা নিয়েছেন আউটসোর্সিং কর্মচারীরা। পরে স্ত্রীকে ৬০৩ নম্বর বেডে এনে ভর্তি করিয়েছেন।
একই অভিযোগ করেন ৬০২ নম্বর বেডে ভর্তি নওগাঁ পৌরসভার কোমাইগাড়ী মহল্লা থেকে আসা রোগী শিউলি বেগম। তিনি বলেন, ‘বুধবার (৬ নভেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে জরুরি বিভাগে এসে ইসিজি ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানোর পর আমার কাছেও রসিদ ছাড়াই অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছেন আউটসোর্সিং কর্মচারীরা।’
সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আউট সোর্সিং কর্মচারী আরাফাত হোসেন লেমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নিজে ইসিজি করি না। সবসময় ইসিজি ইউনিটে থাকতেও পারি না। আমার লোকেরা সেখানে ইসিজি করেন। দিনে সর্বোচ্চ ২০টি ইসিজি হয়। রসিদ ছাড়া টাকা নেওয়া হয় না। তাই সিন্ডিকেটের কোনো প্রশ্নই আসে না।’
হাসপাতালের ইসিজি ইউনিটের ইনচার্জ কার্ডিওগ্রাফার মোমো জাগো নিউজকে বলেন, দুপুরে রসিদ বহির্ভূতভাবে টাকা আদায়ের প্রমাণ পাওয়ার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে তত্ত্বাবধায়ককে জানানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইউনিটের ইনচার্জ হওয়া সত্ত্বেও ২৪ ঘণ্টা তাদের নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয় না। হয়তো এ সুযোগেই তারা এমনটি করেছে। আগামীতে বিষয়টি নজরদারিতে রাখা হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ২৫০ শয্যা নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ইসিজি ইউনিটে রসিদ বহির্ভূত টাকা আদায়ের সত্যতা পাওয়া গেছে। যে বা যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের প্রত্যেককে শোকজ করা হবে। তদন্তসাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে হাসপাতাল প্রশাসন।
এসআর/এএসএম