ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। পুরো নাম আবুল ফয়েজ মুহাম্মদ খালিদ হোসেন। তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান ইসলামি চিন্তাবিদ। বাংলাদেশের প্রথম আলেম উপদেষ্টা।
তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা উপদেষ্টা, মাসিক আত তাওহিদের সম্পাদক, বালাগুশ শরকের সহকারী সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) কোরআনিক সায়েন্সেস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অতিথি শিক্ষক।
আগামী বছরের হজ ব্যবস্থাপনা ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন খালিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ রানা।
জাগো নিউজ: দায়িত্ব নেওয়ার পরই হজের খরচ কমানোর চেষ্টার কথা বলেছিলেন। হজের খরচ গত বছর থেকে কত টাকা কমতে পারে?
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমরা গতকাল (২২ অক্টোবর) বিমান সচিব, বিমানের এমডি, বিমানের পরিচালকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। এনবিআরের চেয়ারম্যান সাহেব ছিলেন, তার সঙ্গেও আলোচনা করেছি। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানও এসেছিলেন। খুবই ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত হিসাবটা আমরা এখনো করিনি। বিমান নীতিগতভাবে খরচ কমাতে রাজি হয়েছে।
প্রতি হজযাত্রীকে এনবিআরকে একটা পেমেন্ট দিতে হয়, এনবিআর বলেছে আমরা সেটা মওকুফ করে দেবো। আমাদের হজযাত্রীরা ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে একটা ট্যাক্স দিতে হয়, উনি (বেবিচক চেয়ারম্যান) আমাদের বললেন তারাও এটা মওকুফ করে দেবেন। এ দুটি ক্ষেত্রে আমাদের সব মিলে ১০ হাজার টাকার মতো কমবে।
হজ এজেন্সিগুলো হজযাত্রীদের প্রতি টিকিটে একটা অ্যামাউন্ট পান। আমরা যেহেতু সবাই হজ প্যাকেজটা জনবান্ধব করতে চাই, কমিয়ে আনতে চাই, তাই তাদের অনুরোধ করবো সেই অ্যামাউন্টটা যাতে তারা না নেন। তাহলে আমরা একটা কনসিডারেবল অ্যামাউন্ট (উপযুক্ত পরিমাণ) কমাতে পারবো বলে আশা করছি।
জাগো নিউজ: এবার হজ প্যাকেজ কয়টি থাকছে?
আ ফ ম খালিদ হোসেন: এবার আমাদের দুটি প্যাকেজ থাকবে। একটি থাকবে কাবার খুব কাছাকাছি। এ প্যাকেজটিতে বাড়ির অবস্থান হবে কাবার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। দোরখুদাই নামে একটা জায়গা দেখে এসেছি। সেটার দূরত্ব আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার। এটার প্যাকেজের টাকা আরও কম হবে। আমি বাড়ি দেখে আসছি খুব বেশি দূরে নয়। এবার আমরা একটা সাশ্রয়ী প্যাকেজ ৩০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবো। এজন্য হিসাব-নিকাশ চলছে।
এবার আমরা একটা সাশ্রয়ী প্যাকেজ ৩০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবো। এজন্য হিসাব-নিকাশ চলছে
জাগো নিউজ: সরকার ২৩ নভেম্বরের মধ্যে নিবন্ধনের তাগিদ দিয়েছিল, কিন্তু এর মধ্যে সাড়া মেলেনি। এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের বিপরীতে মাত্র ৭ হাজার জনের মতো নিবন্ধন করেছেন।
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমরা ২৩ নভেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন শেষ করার একটা অনুরোধ জানিয়েছিলাম। এটার একটা কারণও আছে। সৌদি আরবের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী মিনা ও আরাফায় যে তাঁবু নির্ধারণ, ক্যাটারিং সার্ভিস- এগুলোর প্যাকেজ ঘোষণা করবে ২৩ অক্টোবর। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে আমাদের মিনায় জায়গা নিতে হয়, দেরি করলে আমরা একেবারে শেষ কর্নারে চলে যাবো। যেখান থেকে হাজিদের জামারায় (যেখান থেকে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা হয়) আসতে কষ্ট হবে।
আরও পড়ুন
আমরা চেয়েছিলাম সৌদি আরবের প্যাকেজ অনুযায়ী ২৩ অক্টোবরের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে যারা নিবন্ধন করবেন, আমরা যদি একটা কনসিডারেবল সংখ্যা নিতে পারি তাহলে অন্তত ডি-জোনে আমাদের জায়গাটা বরাদ্দ করতে পারবো। কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের নিবন্ধন চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। ২৩ তারিখের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে করলে আমরা আন্দাজ করতে পারতাম আমাদের কতজন হবে। সেক্ষেত্রে আমরা জোনগুলো নির্ধারণ করতে পারতাম। নিবন্ধনের জন্য ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যথেষ্ট সময় আমরা পাচ্ছি।
জাগো নিউজ: আমরা দেখেছি ধর্মপ্রাণ বিবেচনায় প্রতি বছর সরকারি খরচে অনেকে হজ পালন করেন। এবার সেই সুযোগ থাকছে কি না?
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আগে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ফ্রি হজ করার জন্য যেতেন, এই প্র্যাকটিসটা আমরা বন্ধ করে দেবো। কোনো লোক আমাদের দায়িত্বের বাইরে…হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত নন, কেবল সরকারি টাকায় হজ করবেন, এই প্র্যাকটিসটা আমরা আগামী বছর থেকে বন্ধ করে দিতে চাই। একেবারে বন্ধ করতে না পারলেও সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাই।
জাগো নিউজ: হজ ব্যবস্থাপনায় যে দলগুলো থাকে সেখানে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনেককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমাদের মন্ত্রণালয়ের কিছু মানুষ কিন্তু যেতে হয়। এক লাখ মানুষ হজ করবে, প্রতি ৪৪ জনে একজন হজগাইড লাগে। আমরা ২০০ জন মেডিকেল স্টাফ নিই। এর মধ্যে ৮০ জন এমবিবিএস ডাক্তার। এরপর ফার্মাসিস্ট, টেকনেশিয়ান থাকে। আমাদের সহায়ক দল, কারিগরি দল লাগে। এছাড়া আমরা সৌদি আরবে প্রায় ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিই। গত বছর ১২ জনের বাইপাস সার্জারি হয়েছে, ডায়ালাইসিস হয়েছে। স্পেশালাইজড হাসপাতালে পাঠাতে হয়। মানুষ হারিয়ে যায়, তাদের খুঁজে বের করতে হয়। টাকা হারিয়ে ফেলে, আমরা আবার টাকা দিই।
আমি একটি তালিকা আমার মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করেছি। হজ ব্যবস্থাপনায় যাদের না নিলে নয় এবার আমরা এসব লোককেই শুধু নেবো।
কোনো লোক আমাদের দায়িত্বের বাইরে…হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত নন, কেবল সরকারি টাকায় হজ করবেন, এই প্র্যাকটিসটা আমরা আগামী বছর থেকে বন্ধ করে দিতে চাই। একেবারে বন্ধ করতে না পারলেও সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাই
জাগো নিউজ: জাহাজে হজযাত্রার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এবার সম্ভব হবে কি না?
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমরা সৌদি আরবের হজমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমি একটি প্রস্তাব দিয়েছি, বাংলাদেশের মানুষ সমুদ্রপথে হজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ১৯৮০ সালের পরে এটা আর হয়নি। এর আগে মানুষ জাহাজে করে যেত। সৌদির মন্ত্রী আমাকে বললেন, তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই, যদি আপনারা সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠাতে চান। তবে এ বিষয়ে আমি একটু বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করবো, আপনাদেরও প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। এরই মধ্যে আমরা সৌদি হজমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছি, আপনার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল সেই সম্মতির বিষয়টি আমাদের একটু লিখিতভাবে জানান।
এরই মধ্যে আমরা একটি বড় জাহাজ কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তাদের টিম এসেছিল। তারা আমাদের জানান, সমুদ্রপথে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য তাদের পর্যাপ্ত জাহাজ নেই। এ জাহাজগুলো ভাড়া করতে হবে। সেজন্য এক হাজার কোটি টাকা লাগবে। তারা আমাকে বললেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পেন্ডিং। আপনারা যদি সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠাতে চান আমাদের বড় জাহাজ লাগবে। হিজবুল বাহারের চেয়ে ছয়গুণ বড়। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে হাজিদের আসা-যাওয়া করতে হবে। সেখানে যাতে টার্বুলেন্স না হয়, এরকম বড় জাহাজ লাগবে।
আমরা তাদের (জাহাজ কোম্পানি) বলেছি, আমরা যদি সৌদি সরকার থেকে লিখিতভাবে অনুমতি পাই বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যাপ্রোচ করবো। বাংলাদেশ ব্যাংক শিডিউল ব্যাংকগুলোকে দেবে, ব্যাংক টু ব্যাংক এটা কোনো অনুদান নয়, তারা নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন। তারা ঋণখেলাপিও নয়। এখন আমরা সৌদি সরকারের লিখিত অনুমতির অপেক্ষা করছি। আশা করি আমরা পেয়েও যেতে পারি।
জাহাজ আনতে আমাদের দুই মাস সময় লাগবে, দুই মাস সময় লাগবে প্রস্তুতির জন্য। ছয় হাজার যাত্রী তারা জাহাজে বহন করতে পারবেন, সেই সক্ষমতা তাদের আছে। জাহাজের মধ্যে কনফারেন্স রুমও আছে, সেখানে হাজিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
আগামী বছর ৫ জুন হজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি আমরা এ বছর করতে পারি, আলহামদুলিল্লাহ। যদি জটিলতার কারণে নাও করতে পারি, পরবর্তী বছরের জন্য একটা দ্বার উন্মুক্ত করে যেতে পারবো। এটা আমাদের প্রত্যাশা।
জাহাজ আনতে আমাদের দুই মাস সময় লাগবে, দুই মাস সময় লাগবে প্রস্তুতির জন্য। ছয় হাজার যাত্রী তারা জাহাজে বহন করতে পারবেন, সেই সক্ষমতা তাদের আছে। জাহাজের মধ্যে কনফারেন্স রুমও আছে, সেখানে হাজিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
জাগো নিউজ: আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার কথা বলেছিলেন।
আ ফ ম খালিদ হোসেন: ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আমরা আপাতত একজন অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি তার কাজের অতিরিক্ত হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা একজন যোগ্য কর্মকর্তাকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে দেবো। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বিষয়গুলো দেখবেন। তখন আমরা বলেছিলাম, কিন্তু এখন তো সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে।
জাগো নিউজ: মডেল মসজিদ নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আছে?
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারা আমাদের ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকারি বিধি অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
জাগো নিউজ: আপনারা দায়িত্ব নেওয়ার পর সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ছিল। আপনি এগুলো নিয়ে তৎপর ছিলেন। এসব ঘটনার নেপথ্যে কী ছিল?
আ ফ ম খালিদ হোসেন: হামলা, অনেক সময় এগুলো রাজনৈতিকভাবে হয়। সরকার যখন পরিবর্তন হয়েছে অনেক মুসলমানের ঘরেও তো আগুন দিয়েছে। যদি কোনো সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজনীতি করেন, তার ঘরেও আগুন দিয়েছে। এগুলো অনেকটা পলিটিক্যালি মোটিভেটেড। এগুলোর সঙ্গে কমিউন্যাল কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে এগুলো মনিটর করেছি। দুর্গাপূজাটা শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে ৬৪ জেলার ডিসি-এসপিদের সঙ্গে মিটিং করেছি। মাজারেও তো হামলা হয়েছে। আমরা এগুলো মনিটর করেছি এবং সতর্কতা অবলম্বনের কারণে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দেশে একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে।
জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
আ ফ ম খালিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ
আরএমএম/এএসএ/এমএস