বিশ্ব ব্যাংক সদর দফতরে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকদের সঙ্গে আয়োজিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, বাইরের চাপে বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছিল।
সোমবার (১ মে) স্থানীয় সময় সকালে ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকের সদর দফতরে সংস্থাটির বোর্ড অব এক্সিকিউটিভ ডিরেকটরসের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক এক মতবিনিময় সভায় শেখ হাসিনা এ দাবি করেন।
যমুনা টেলিভিশনের সবশেষ আপডেট পেতে Google News ফিড Follow করুন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি হতাশ। বাইরের চাপের কারণে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে এসেছিল।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যেকার অংশীদারিত্বের ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন আমাদের অংশীদারিত্বের ভবিষ্যতের দিকে দেখতে চাই। বিশ্বব্যাংককে অবশ্যই তার মূল উদ্দেশ্য- দারিদ্র বিমোচন এবং উন্নয়ন অর্থায়নের প্রতি মনোযোগী থাকতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশ্বব্যাংকের অংশীদারিত্বের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ বিলিয়ন ডলারের ৫৩টি বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে বিশ্বব্যাংকের। এটি এখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংকের দেয়া ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান এবং ঋণের অংশ। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সুযোগ এবং গ্রহণ করার ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ কখনও ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি বা তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েনি।
তিনি আরও বলেন, নিজস্ব অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সম্পদ দিয়ে ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার লক্ষণ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার মধ্য দিয়ে জনগণকে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতি রেখেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংক সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা অব্যহত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাংকসহ আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের আমাদের ডিজিটাল এবং ভৌত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। বাণিজ্য বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ প্রচার-প্রচারণা এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আমরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাই।
এ সময়, আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা, বিনামূল্যে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, বিদ্যুৎ অ্যাক্সেস এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ অসাধারণ উন্নতি করেছে।
বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ, মানসম্পন্ন শিক্ষা, শিশু কল্যাণ, দক্ষতা বৃদ্ধি, নগর উন্নয়ন, টেকসই শিল্পায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব ব্যাংককে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছর ভূ-অর্থনীতিতে গোটা বিশ্ব বড় কিছু পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করবে, যার প্রভাব বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অর্থনীতিতে পড়বে। এজন্য বিশ্ব ব্যাংককে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এ সময় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশ্ব ব্যাংককে তার বিশেষ ছাড়ে অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা্।
রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি যখন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে তখন বিশ্বব্যাংক ১ দশমিক ২ মিলিয়ন রোহিঙ্গার জন্য অনুদান সহায়তা বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যহত রাখবে বলেও আশা করেন করেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের কথা ভুলে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, বিশ্ব যেন এ অসহায় মানুষগুলোকে ভুলে না যায়।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য অধিকতর উন্নত বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ভাসানচর দ্বীপে ১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য চমৎকার সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপির সঙ্গে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। তিনটি মানদণ্ডেই যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হতে উত্তরণ হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র সীমা কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে এবং চরম দারিদ্র ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে। কোভিড-১৯ মহামারি, ইউরোপে যুদ্ধ এবং গভীরতর জলবায়ু সংকটের কারণে সৃষ্ট বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এসব অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলাদেশের তরুণরা বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিবে আশা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি নিশ্চিত, আমাদের তরুণরা সঠিক রাজনৈতিক পরিবেশে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। জাতির একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আমরা আমাদের ভূমিকা আরও সম্প্রসারিত করতে চাই।
তিনি বলেন, “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়” এই বৈদেশিক নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক কূটনীতি অব্যাহত রাখবে।
/এসএইচ