রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন প্রিয়াংকা হাউজিংয়ের কয়েকটি ভবন অপসারণে নির্দেশনা দিয়েছে সিভিল অ্যাভিয়েশন। বিমানের উড্ডয়ন ও অবতরণ জটিলতা দেখা দেওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিল্ডিং কোড না মেনে এ ভবনগুলো কীভাবে অনুমোদন হলো, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় খোদ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
বিষয়টি অনুসন্ধানে সংস্থাটি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অবাক করার বিষয় হলো, যারা অবৈধভাবে এই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিলেন, তাদেরকে নিয়েই গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। অনিয়ম ‘ধামাচাপা’ দিতে একটি পক্ষ এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রাজউক কর্মকর্তাদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ নভেম্বর রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) মো. মনিরুল হকের সই করা চিঠিতে বলা হয়, প্রিয়াংকা সিটি হাউজিংয়ের ছয়টি প্লটে ওএলসের প্রাপ্য উচ্চতার চেয়ে অধিক উচ্চতায় ভবন নির্মাণের অভিযোগে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।
কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে রাজউকের প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদকে। সদস্য হিসেবে আছেন পরিচালক (জোন-১), নির্বাহী প্রকৌশলী (ডিজাইন) রাহাত মুসলেমীন, উপ-পরিচালক (উন্নয়ন-১) এবং সদস্যসচিব করা হয়েছে অথরাইজড অফিসার জোন-১। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।
যাদের নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি
জাগো নিউজের হাতে আসা অনুমোদনের কপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভবনগুলোর নকশা ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। প্রিয়াংকা সিটির এসব ভবন অনুমোদনে সই করেছেন রাহাত মুসলেমীন, মোস্তাক আহমেদ, নাসির উদ্দীন ও ইমরুল হাসান। অর্থাৎ, যারা অবৈধভাবে বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন, তারাই এ অনিয়মের তদন্তকাজ করছেন।
২২ দিনে ১০তলা ভবন!
রাজউকের অথোরাইজড কর্মকর্তা ইমরুল হাসানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, রাজধানীর গুলশান আবাসিক এলাকার বাড়ি নম্বর ১/বি, প্লট নম্বর-১, সড়ক নম্বর ১১৩, সিইএস-এ ব্লকের ১০তলা বাড়িটি ভবন নির্মাণের পর রাজউক অনুমোদন দেয়। এই ভবনে নিয়মের ব্যত্যয় করেছেন কর্মকর্তা ইমরুল ইসলাম।
ভবনের আবেদনের কপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য আবেদন করা হলেও অনুমোদন দেওয়া হয় বাণিজ্যিক ভবনের। বাণিজ্যিক ভবনে দুটি সিঁড়ি থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ভবনটিতে ছিল একটি। পরে অনিয়ম ঢাকতে ছোট্ট জায়গা দিয়ে লোহার সিঁড়ি করা হয়েছে। অথচ ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী—কোনো ভবনে এমন পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
নকশা অনুমোদন
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—ভবনটি নির্মাণের অনুমোদন পেতে আবেদন করা হয় ২০২৩ সালের ৫ জুলাই। আর ভবন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় একই বছরের ২৭ জুলাই। অর্থাৎ, মাত্র ২২ দিনে বেজমেন্টসহ ১০তলা ভবন নির্মাণ ও আবাসিক থেকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে।
রাজউকের কর্মকর্তারা জানান, রাজউক বিধি অনুযায়ী রিভাইজড নকশা অনুমোদন করে। সেসময় পূর্বের নকশার মেয়াদ দেখা হয়। এছাড়া ভবন নির্মানের জন্য ভূমি খালি থাকতে হয়। অথবা আগের নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করা হলে (রাজউকের নিয়মের ব্যত্যয় না করে) নির্ধারিত রাজউক ফি ও দশগুণ জরিমানা দিয়ে রিভাইজড নকশা অনুমোদন করা হয়।
কিন্তু গুলশানের ভবনটিতে দেখা যাচ্ছে, ভয়েডের ভেতর স্লাব বাড়িয়ে ও পরে নতুন সিঁড়ি সংযোজন করা হয়েছে। এরপরও ভবনটিতে রিভাইজড নকশা অনুমোদন ও অকুপেন্সি সনদ দেওয়া হয়েছে। যার নম্বর ১৩৮১/২।
এদিকে, প্রগতি সরণিতে অবস্থিত ক্যানাডিয়ান ভার্সিটির ভবনের আটতলা অনুমোদন নেওয়া হলেও ফ্লোর স্পেস বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া পূর্বাচলে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে নকশা অনুমতিতেও নিয়মের ব্যত্যয় করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মো. আলম মোস্তফার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
নির্মাণ অনুমোদন
অথোরাইজড কর্মকর্তা ইমরুল হাসান বলেন, ‘নকশা অনুমোদন দেওয়া হয় কমিটির মাধ্যমে। আমি অথোরাইজড কর্মকর্তা হিসাবে ছিলাম। প্রিয়াংকা হাউজিংয়ের বিষয়ে রাজউক ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের একাধিক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তবে আমি মনে করি এসব ভবনের নকশা অনুমোদনে কোনো সমস্যা নেই। হয়তো হাউজিংয়ের মালিকরা নকশা অগ্রাহ্য করেছেন।’
গুলশানে ২২ দিনে ১০তলা ভবন নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই ভবনের জন্য ১৪তলার অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। পরে রাজউক ১০তলার অনুমোদন দিয়েছে। তবে ভবনে কোনো ব্যত্যয় হয়েছে কি না, সেটি পরিদর্শক বলতে পারবেন।’
এএএইচ/এসআর