• শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের উসকানির অভিযোগ
• ঢাকা রেসিডেনসিয়ালে আন্দোলনের পর ফন্দি আঁটছে অনেকে
• পরীক্ষা ফেরাতে মরিয়া, নেপথ্যে ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য
• লটারি ছাড়া ভর্তির সুযোগ নেই, উসকানি দিলেই ব্যবস্থা
করোনা মহামারিকালীন স্কুলে ভর্তিতে পরীক্ষা না নিয়ে লটারি চালু করে সরকার। অনেকাংশে কমে যায় ভর্তিবাণিজ্য। পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে রমরমা কোচিং ও টিউশন বাণিজ্যেও ভাটা পড়ে। এতে মধ্য ও নিম্নবিত্ত অভিভাবকরা স্বস্তি প্রকাশ করেন। পরে এ পদ্ধতিকে স্থায়ী রূপ দেয় শিক্ষা প্রশাসন। এ বছর হঠাৎ একটি পক্ষ আবার পরীক্ষা পদ্ধতি ফেরাতে মাঠে নেমেছেন। তবে সরকার লটারি পদ্ধতিতে অনড়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভর্তি প্রক্রিয়ায় আবারও পরীক্ষা ফেরানোর দাবি তোলেন কিছু অভিভাবক। তাদের সুরে সুর মেলান কোচিং বাণিজ্যে জড়িত কিছু শিক্ষক এবং নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাতে সাড়া দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। এবারও বহাল রয়েছে লটারি পদ্ধতি। গত ১২ নভেম্বর থেকে ভর্তির আবেদন শুরু হয়েছে। কয়েক লাখ শিক্ষার্থী আবেদনও করেছেন।
হঠাৎ রোববার (১৭ নভেম্বর) লটারি পদ্ধতি বাতিল করে পরীক্ষা ফেরানোর দাবিতে আন্দোলনে নামেন রাজধানীর নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির একাদশ ও দ্বাদশের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এতে অংশ নেন তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। তারা দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। শিক্ষার্থীরা ‘লটারি না মেধা, মেধা মেধা’ বলে স্লোগান দেন। এরপর থেকে অনেক অভিভাবক, শিক্ষকসহ অনেকে ফেসবুকে সরব হয়েছেন। তাদের কেউ লটারিকে ভালো পদ্ধতি, আবার কেউ পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি করা উচিত বলে মতামত দিচ্ছেন।
এখানে লটারির মাধ্যমে ভর্তি হলে কিছু অসুবিধা রয়েছে। সেজন্য আমরা সব সময় মেধা যাচাই বা পরীক্ষার মাধ্যমে এখানে ভর্তি নিতে আগ্রহী। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও সেটা চান।- রেসিডেনসিয়ালের গভর্নিং বডির সদস্য সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরুন্নবী
শিক্ষা প্রশাসন বলছে, আবেদন প্রক্রিয়া শুরুর প্রায় এক সপ্তাহ হতে যাচ্ছে। এমন সময়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামিয়ে শিক্ষক ও ভর্তি বাণিজ্যে জড়িতরা ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। অভিভাবকদের চেয়ে বরং শিক্ষকদের একটি পক্ষই শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছেন। একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করার পর আরও অনেকে এ পথে হাঁটছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। যারাই শিক্ষার্থীদের উসকানি দেবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আন্দোলনে শিক্ষকদের উসকানি?
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রোববার সকাল ১০টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ১০-১২ মিনিট পর তারা রাস্তা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে যান। অথচ কিছুক্ষণ পরই তারা আবার রাস্তায় নেমে অবরোধ করেন। দ্বিতীয় দফায় শিক্ষার্থীদের রাস্তায় পাঠানোর পেছনে শিক্ষকদের উসকানি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন
সরেজমিনে দেখা যায়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী বেশি। তবে তাদের সঙ্গে সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও ছিল। তাদের অনেকে লটারির মাধ্যমে রেসিডেনসিয়ালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অথচ তারাও লটারির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।
লটারিতে চান্স পেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্যাররা অনেক চেষ্টা করেছেন, যাতে আমাদের স্কুলে লটারি বাদ যায়, ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেটা না পারায় আন্দোলন করতে বলেছেন, সেজন্য আমরা এসেছি।’
যদিও শিক্ষকরা সরাসরি বিষয়টি স্বীকার করছেন না। তাদের ভাষ্য, ‘বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মনে করছেন, লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করলে যে সুনাম ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের রয়েছে, তা ক্ষুণ্ন হবে। সেই জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সদস্য (শিক্ষক প্রতিনিধি) সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরুন্নবী জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্বায়ত্তশাসিত অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। কোনো এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মতো আমরা নই। এখানে আবাসিক ব্যবস্থা আছে। শিক্ষার্থীদের বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। এখানে লটারির মাধ্যমে ভর্তি হলে কিছু অসুবিধা রয়েছে। সেজন্য আমরা সব সময় মেধা যাচাই বা পরীক্ষার মাধ্যমে এখানে ভর্তি নিতে আগ্রহী। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও সেটা চান।’
রাজধানীর রামপুরার উলন রোডের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে নাঈফুল হাসানাত। তাকে এবার সরকারি অথবা বেসরকারি ভালো স্কুলে ভর্তি করাবেন তার বাবা-মা। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ভর্তি ব্যবস্থাপনার অধীনে আবেদনও করেছেন। তবে তাদের প্রথম পছন্দ ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। এখানে পৃথক ব্যবস্থাপনায় ভর্তির লটারি হয়।
জানতে চাইলে নাঈফুল হাসানাতের মা সালমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘লটারি হবে জেনে ছেলেকে ভর্তি পরীক্ষার কোনো প্রস্তুত নেওয়ার ব্যবস্থা করিনি। আজ দেখি রেসিডেনসিয়ালে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আন্দোলন হচ্ছে। এখন যদি তারা পরীক্ষা নেন, তাহলে তো আমার ছেলে ভালো করতে পারবে না। আমি মনে করি, লটারিটাই ভালো।’
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ সূত্র জানায়, চলতি বছর শুরু থেকেই ভর্তি পরীক্ষার নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। গভর্নিং বডিতে এটা নিয়ে অনেক আলোচনার পর মর্নিং শিফটে (প্রভাতী শাখা) ভর্তি পরীক্ষা এবং ডে শিফটে (দিবা শাখা) লটারির মাধ্যমে ভর্তির সিদ্ধান্ত হয়।
লটারি পদ্ধতিতে ইচ্ছামতো ভর্তির সুযোগ নেই। অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগও নেই বললেই চলে। সেজন্য অনেকের হয়তো এটা পছন্দ হচ্ছে না। কেউ যদি সেটা করে ফায়দা লুটতে চান, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের
বিষয়টি নিয়ে দুই শিফটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। পরে একাদশ শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী, অধ্যক্ষ, শিক্ষক মিলে শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করেন। সচিব ঝামেলার বিষয়টা জেনে ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী সব শাখায় লটারির মাধ্যমে ভর্তির চূড়ান্ত নির্দেশ দেন। এতে গভর্নিং বডির সদস্য ও শিক্ষকরা নিরূপায় হয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পথে ঠেলে দেন।
শিক্ষা সচিবের সঙ্গে সেদিনের বৈঠকে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরুন্নবীও। তিনি বলেন, ‘আমরা দুই শিফটে যেন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেজন্য সচিবের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি সব শুনে দুই শিফটে লটারি হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন। এতে শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট। তারা পরীক্ষা হোক, সেটাই চাইছে। এরপর হয়তো ওরা আন্দোলন করছে।’
পরীক্ষা ফেরানোর নেপথ্যে কোচিং বাণিজ্য?
ঢাকায় বহু সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অল্প কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সন্তানদের নামি এসব স্কুলে ভর্তি করাতে মরিয়া অভিভাবকরাও। এ সুযোগ নিয়ে কোচিং বাণিজ্যে মেতে ওঠেন শিক্ষকরা। গোপনে বাসায় বা বিভিন্ন জায়গায় তারা ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে উচ্চ ফি নিয়ে কোচিং করান বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি কিছুটা হলেও সত্য বলে মানেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরুন্নবীও। তিনি বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্যের প্রশ্নটা আসে। তবে আমরা এবার গভর্নিং বডির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শিক্ষকরা কোনোভাবেই কোচিং করাতে বা টিউশন করাতে পারবেন না। আর এনসিটিবির নির্ধারিত পাঠ্যবই থেকে প্রশ্ন করা হবে। যেমন—কেউ তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিলে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির বই থেকে প্রশ্ন করা হবে। বাইরে থেকে বা অন্য ক্লাসের বই থেকে প্রশ্ন করা হবে না। এটা করা গেলে কোচিং বাণিজ্য কমবে।’
‘তারপরও যদি কেউ বাইরে কোচিং করে, সেটাও তো খারাপ নয়। বাচ্চাদের ফাউন্ডেশনটা (প্রাথমিক ভিত্তি) মজবুত হবে’ বলেও উল্লেখ করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি এ সদস্য।
লটারি ছাড়া ভর্তি নয়, উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ ঢাল হিসেবে দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের লটারির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঠেলে দিলেও কোনো লাভ হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা। তারা বলেন, এবার যে নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে, তা মেনেই ভর্তি নিতে হবে। বরং কেউ যদি শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভর্তির বিষয়টি দেখভাল করে মাউশির মাধ্যমিক বিভাগ। এ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছরই প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তির নীতিমালা করা হয়। এবারও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে নীতিমালা করেছে। নীতিমালায় লটারি পদ্ধতি আছে। এটাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মানতে হবে। এর বাইরে কেউ ভর্তি করাতে পারবে না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। একই বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীরা কেন আন্দোলন করছে, কাদের জন্য করছে; সেটাও প্রশ্ন। যারা আন্দোলন করছে, তারা ভর্তি হবে না। তাহলে তাদের স্বার্থটা কী? এখানে স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের কেউ উসকে দিচ্ছে—এমনও হতে পারে।
তিনি বলেন, লটারি পদ্ধতিতে ইচ্ছামতো ভর্তির সুযোগ নেই। অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগও নেই বললেই চলে। সেজন্য অনেকের হয়তো এটা পছন্দ হচ্ছে না। কেউ যদি সেটা করে ফায়দা লুটতে চান, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্কুলে ভর্তিতে সারাদেশে আসন কত
মাউশি সূত্র জানায়, এ বছর সারাদেশের ৫ হাজার ৬২৫টি সরকারি-বেসরকারি স্কুলে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এসব স্কুলে মোট ভর্তিযোগ্য শূন্য আসন ১১ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৩টি। এর মধ্যে ৬৮০টি সরকারি স্কুলে আসন ১ লাখ ৮ হাজার ৬৬২টি। ৪ হাজার ৯৪৫টি বেসরকারি স্কুলে ভর্তিযোগ্য আসন ১০ লাখ ৭ হাজার ৬৭১টি। এ পর্যন্ত সরকারি স্কুলে আবেদন পড়ার হার বেশি। বেসরকারি স্কুলে আগ্রহ কম শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের।
এএএইচ/এএসএ/এমএস