সিনথিয়া…. লিঙ্গ বৈচিত্র্যের কারণে যার শৈশব কেটেছে মানুষের অবজ্ঞা আর অসম্মানের মধ্য দিয়ে। ধাক্কা খেয়েছেন বার বার। আবার ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন। চেষ্টা ছিলো জীবনটাকে গড়বেন নিজের মতো করে। ঘাত প্রতিঘাত এলেও সামলেছেন শক্ত হাতে। অদম্য মনের শক্তি আর শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতায় সিনথিয়া গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। এবার আপনাদের জানাবো সিদ্দিক থেকে সিনথিয়া হয়ে ওঠা একজন সফল মানুষের সফলতার গল্প।
ঢাকার গোড়ানের এই ভবনটি বলছে সিনথিয়ার আত্মবিশ্বাসের কথা। সাক্ষ্য দিচ্ছে একজন মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর। রুটি রুজির যোগান দিচ্ছে কয়েক হাজার কর্মীর।
উদ্যোক্তা সিনথিয়া ভুঁইয়া বললেন, আমার মনোবল ছিল যে আড়ংয়ে ঢুকলে আমি কাজ করবো, যেমনে হোক কাজ আমি করবোই। আমার এই মনোবলটা ছিল যে, আমি রাস্তায় নামবো না। আমি কারো কাছে হাত পাতবো না। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তাদেরকে আমি দেখাবো যে আমি পারছি।
সিনথিয়ার এ প্রতিষ্ঠান একদিনে গড়ে ওঠেনি। জীবনের বাঁকে বাঁকে ছিলো শত প্রতিবন্ধকতা। পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠা এই মানুষটির চলার পথ সহজ ছিলো না কখনও।
সিনথিয়া বলেন, নারী আর পুরুষের মাঝখানের একটা জীবন আমাদের। আমার নাম প্রথমে ছিল সিদ্দিক। পরে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আমি আমার নাম ‘সিনথিয়া’ ই বলবো। আমি জোর গলায় ‘আমার নাম সিনথিয়া’ বলতে থাকি। মার্কেটে গেলে তারা তো আমাকে জায়গা দিতোই না বরং কখনও কখনও মার খেতে হয়েছে, ঢিল ছুঁড়েছে, বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হয়েছি।
উদ্যোক্তা সিনথিয়া আরও বলেন, আমার এ সেন্টারে এখন ২০০ লোক কাজ করছে। আর বাইরে যারা কাজ করছেন তাদের সংখ্যা আরও ২০৫০ জন। সম্প্রতি নতুন করে আরও ৫০ জন যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৫০ জন আছেন যারা ট্রান্সজেন্ডার।
সিনথিয়া জানান, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রথমে গরুর খামার করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৮ সালের বন্যার পর সেই খামার ক্ষতির মুখে পড়লে শুরু হয় তার নতুন যুদ্ধ। মায়ের কাছে শেখা সেলাই এর কাজ দিয়েই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু।
শুরুর দিকের সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করে সিনথিয়া ভুঁইয়া বললেন, আমি চিন্তা করলাম যে আমি কিছুতেই বসে থাকবো না। এটাকে বাদ দিয়ে আর কী করা যায় ভাবতে থাকলাম।
স্মৃতিচারণ করতে করতেই হাস্যোজ্জ্বল সিনথিয়া বললেন, প্রথমদিন আড়ংয়ের মগবাজারের শো রুমে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে এগুলো যে বানাচ্ছেন এগুলো কী আপনারা উপর থেকে বানিয়ে নিচে নিয়ে আসেন? তো তারা বললেন যে, আমাদের বিশাল প্রোজেক্ট আর প্রোডাকশন হাউস আছে।
সিনথিয়া আরও বলেন, আমি ভাবলাম যে- দেখি এখানে ঢুকে যে কী হয়। কারণ, আমার ছোট ভাইবোনেরা বড় হয়ে যাবে। আমাকে ওদের অধীনে থাকতে হবে সারাজীবন। তখন আমি আমার মনোবল বাড়ালাম এই ভেবে যে, আমি যেহেতু ফার্ম চালিয়েছি তাহলে এটাও আমি পারবো।
লিঙ্গ বৈচিত্রের কারণে আঘাত এসেছে বার বার। তবে প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সিনথিয়া।
সিনথিয়া বলেন, যখন আড়ং এ যাই তারা আমাকে গ্রহণ করে। এর আগে আমি কখনও লিফটে উঠিনি, তো সেখানে থাকা সিকিউরিটি গার্ড আমাকে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে লিফটে চড়তে হবে। এরপর একজন ডিজাইনারকে ডাকা হলো, ওনার নাম ছিল রুবি আপা। আপা এসে এতো সুন্দর ব্যবহার করলেন যে আমার মনে হচ্ছিলো আমার মা আমার সাথে কথা বলছেন। উনিই আমাকে দুইটা ডিজাইন এনে দিয়ে বললেন যে, এই দুইটা ডিজাইন করবেন ভয়েল কাপড় দিয়ে।
তারপরের গল্পটা সিনথিয়ার সাহস আর সাফল্যের। সিনথিয়ার এই সাহস এখন ছড়িয়ে গেছে অনেকের মাঝে। সিনথিয়ার প্রতিষ্ঠানেই এখন কাজ করছেন দুই শতাধিক লিঙ্গ বৈচিত্রপূর্ণ মানুষ। তাদের মধ্যে কয়েকজন বললেন, ম্যাডামের জন্যই ভালো আছি। এখন কাজ করছি আর এজন্য যে সম্মান পাচ্ছি তার পুরোটাই তার জন্য।
বাংলাদেশের হৃদয় হতে এ সফলতার গল্প আরও পরিণত হবে, এগিয়ে যাবে।
/এসএইচ