Site icon Amra Moulvibazari

‘নীল আকাশের নিচে নরক দেখেছি’, ভারতে মুসলিমদের করুণ পরিণতি

‘নীল আকাশের নিচে নরক দেখেছি’, ভারতে মুসলিমদের করুণ পরিণতি


ভারতের আসাম রাজ্যের ৬৭ বছর বয়সী সাইকেল মেরামতকারক ওফা আলী। ৩১ মে নিজের ভাড়া বাড়িতে ফিরে এলেও, ঠিক তার আগের চার দিন কেটেছে পাশের দেশ বাংলাদেশে আটক থেকে।

চলতি বছরের ২৩ মে ওফা আলীকে আসাম পুলিশ গ্রেফতার করে মোরিগাঁও জেলার কুয়াদল গ্রামের ভাড়া বাড়ি থেকে, যেখানে ‘ঘোষিত বিদেশি’দের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার অভিযান শুরু করেছে। আসাম এমন একটি রাজ্য, যেখানে শতবর্ষব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসতির কারণে আদিবাসী আসামিদের সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই টানাপড়েনপূর্ণ।

এই উত্তেজনা ২০১৬ সালের পর আরও বেড়েছে, যখন নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রথমবারের মতো আসামের ক্ষমতায় আসে। প্রায় ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার রাজ্যটিতে এক তৃতীয়াংশের বেশি মুসলিম, যা ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ অনুপাতে।

আলী হচ্ছেন সেই ৩০০-রও বেশি মুসলিমদের একজন, যাদের মে মাস থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। রাজ্য বিধানসভায় তিনি বলেন, এই পুশব্যাক আরও জোরদার হবে। রাজ্য রক্ষায় আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।

‘নীল আকাশের নিচে নরক’

২৩ মে গ্রেফতার হওয়ার পর আলীকে নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গোলপাড়া জেলার মাতিয়া বন্দি কেন্দ্রে, যা ভারতের সবচেয়ে বড় অবৈধ অভিবাসী হোল্ডিং সেন্টার। এরপর ২৭ মে ভোরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ওফা আলী আলীসহ আরও ১৩ জনকে (তাদের মধ্যে ৫ জন নারী) একটি ভ্যানে করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যায়।

বিএসএফ আমাদের জোর করে ওপারে ঠেলে দিতে চাইছিল, অথচ বিজিবি ও স্থানীয় বাংলাদেশিরা বলছিলেন, তারা আমাদের নেবে না কারণ আমরা ভারতীয়, আল জাজিরাকে বলেন আলী।

তারা ১২ ঘণ্টা ধরে কাদা-পানির ভেতর কোনো খাবার বা আশ্রয় ছাড়াই কাটান।

ওফা আলী বলেন, আমরা নীল আকাশের নিচে নরক দেখেছি। ভারতের দিকে ফিরতে চাইলে বিএসএফ তাদের রাবার বুলেটে গুলি করে বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, আমরা তাদের অনুরোধ করি আমাদের না ঠেলে দিতে, কিন্তু তারা গুলি চালায়।

পাশের গোলাঘাট জেলা থেকে আটক ৫০ বছর বয়সী রাহিমা বেগম বলেন, আমি যখন দৌড়ে বাংলাদেশের দিকে যেতে চাইলাম, বিজিবি আমাকে মারধর করে। আর বিএসএফ বলছিল, যদি না যাও, গুলি করবো।

কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই মুসলিমদের?

গত মাসজুড়ে আসামের বিভিন্ন জেলা থেকে মুসলিমদের আটক করে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের রৌমারী সীমান্ত থেকে সংবাদকর্মী জিতেন চন্দ্র দাস আল জাজিরাকে বলেন, তিনি বিএসএফ সদস্যদের রাবার বুলেট ছুড়তে ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে মুসলিমদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে দেখেছেন।

বিএসএফ অবশ্য ২৭ মে এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তারা কেবল বাংলাদেশিদের ভারতে প্রবেশ ঠেকাচ্ছিল।

পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয় যে, বাংলাদেশের স্থানীয় বাসিন্দা ও বিজিবি কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে আলীকে শেষ পর্যন্ত মেঘালয়ের এক সীমান্ত পয়েন্টে ফেরত পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি ১০ ঘণ্টা হেঁটে ও পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন।

আসামভিত্তিক দৈনিক ‘দ্য সেনটিনেল’ জানায়, বিএসএফ ৬৫ জন ভারতীয় নাগরিককে বিজিবির কাছ থেকে গ্রহণ করেছে।

কাশ্মীর হামলার পর আরও ঘৃণা

গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারতজুড়ে মুসলিমবিরোধী মনোভাব আরও বাড়ে।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলেন, এই হামলার পর বিজেপি সরকার দুর্বল মুসলিম গোষ্ঠীদের টার্গেট করার অজুহাত পায়। তাদের চোখে যেকোনো মুসলিম মানেই সন্ত্রাসবাদ।

নাগরিকত্ব নিয়েও বৈষম্য

ওফা আলী আলীর নাম ২০১৯ সালের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনে (এনআরসি) থাকলেও, ২০১৩ সালে তার বাবার নাম ‘সামত আলী’, ‘চমত আলী’ ও ‘চাহমত আলী’ নামে বিভিন্ন নথিতে আসার কারণে তাকে বিদেশি ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল।

তিনি এরপর দুই বছর বন্দি অবস্থায় ছিলেন ও রাজ্যের হাইকোর্টও এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে লড়তে আলী সুপ্রিম কোর্টের শরনাপন্ন হননি; কারণ, সেই সামর্থ্য তার নেই।

ভারত সরকার কর্তৃক জারি করা ওফা আলীর নথি ও পরিচয়পত্র (আরশাদ আহমেদ/আল জাজিরা)

আল জাজিরা বলছে, এমন অনেক মুসলিম রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে মামলা এখনো বিচারাধীন, এরপরও তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, যাদের মামলা বিচারাধীন, কিছু ক্ষেত্রে তাদের ‘কূটনৈতিকভাবে’ ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

প্রকৃত ভারতীয় নাগরিককেও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে

৫০ বছর বয়সী ট্রাকচালক নিজাম আহমেদের নাম এনআরসিতে থাকলেও, তাকেও সীমান্তে পাঠানো হয়। তার ছেলে জাহিদ জানায়, ভিডিওতে নিজামকে বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে দেখা গেলে পরিবার বিষয়টি জানতে পারে।

জাহিদ বলেন, আমার দাদু আসাম পুলিশের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে ছিলেন। বাবাকে এই অবস্থায় দেখে তিনিই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতেন।

পশ্চিমবঙ্গের হস্তক্ষেপ

মহারাষ্ট্র রাজ্যে সাতজন মুসলিমকে ‘বিদেশি’ বলে গ্রেফতার করে বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ১৫ জুন তারা ফেরত আসে। কারণ তারা আসলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সামিরুল ইসলাম বলেন, ওদের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারকে না জানিয়েই।

‘মিয়ারা (মুসলমা)’ নিরাপদ নয়

আসামের গোলাঘাট জেলার নোয়াজান গ্রাম থেকে ২৫ মে গ্রেফতার হন আব্দুল হানিফ। কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বড় ভাই দিন ইসলাম বলেন, পুলিশ বলেছিল দুই দিনের মধ্যে ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু আজ পর্যন্ত খোঁজ নেই।

আমরা মিয়া (মুসলমান) বলেই সন্দেহভাজন, বলেন তিনি। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, হানিফকে বিএসএফের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।

কূটনৈতিক আপত্তি ও বিচার বিভাগীয় প্রশ্ন

কমপক্ষে ১০ জন ভারতীয় মুসলিমের খোঁজ মেলেনি বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। চারটি পরিবার আসাম হাইকোর্টে মামলা করেছে। যাদের অনেকে ‘দেশি মুসলিম’ হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশ সরকার ভারতকে কূটনৈতিক চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বিএসএফ যেভাবে প্রক্রিয়া ছাড়া মানুষ ঠেলে দিচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।

এদিকে, বিশেষজ্ঞদের মতে এই ‘পুশব্যাক’ আসলে ‘ফোর্সড ডিপোর্টেশন’ বা ‘জোরপূর্বক নির্বাসন’। হাইকোর্টের আইনজীবী ওলিউল্লাহ লস্কর বলেন, ১৯৫০ সালের আইন অভিবাসীদের প্রবেশ রোধের জন্য, দীর্ঘকাল বসবাসকারী নাগরিকদের বিরুদ্ধে নয়।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া একটি হলফনামায় আসাম সরকার বলেছিল, যাদের বাংলাদেশে পরিচয় নেই, তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।

দ্বিমুখী নীতি ও সিএএ

২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) আওতায়, মুসলিম ব্যতীত সব ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব সহজ করা হয়েছে। এই আইনে বলা হয়, যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে এসেছে, তারা আবেদন করতে পারবে। কিন্তু মুসলিমদের ক্ষেত্রে ২০-৩০টি প্রমাণপত্র লাগছে।

ওফা আলী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, হিন্দু হলে শুধু বললেই হবে, আমরা মুসলিমরা শত প্রমাণ দিয়েও প্রমাণ করতে পারছি না।

গোলাঘাটে নিজের ঘরের বাইরে বসে থাকা রাহিমা বেগম বলেন, এই দেশ আমার, কিন্তু আমি এই দেশের নই।

সূত্র: আল জাজিরা

এসএএইচ

Exit mobile version