Site icon Amra Moulvibazari

সেদিন শরণার্থী শিবিরে আলোর দূত হয়ে আসেন ধাত্রী শাকিলা

সেদিন শরণার্থী শিবিরে আলোর দূত হয়ে আসেন ধাত্রী শাকিলা


সময়টা জুলাই ২০২১, ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। দিনের পর দিন টানা বৃষ্টিতে চারদিক প্লাবিত। তবু থেমে থাকেননি ধাত্রী শাকিলা পারভিন। মাতৃত্বের যন্ত্রণায় কাতর এক গর্ভবতী নারীর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আজ ধাত্রী দিবসে নতুন করে আলো ফেলে নারীর স্বাস্থ্যসেবায় এই পেশার অনন্য গুরুত্বে।

২০১৯ সাল থেকে ইউএনএফপিএ-র প্রশিক্ষিত ধাত্রী হিসেবে শাকিলা পারভিন কাজ করছেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে। সীমিত সুযোগ-সুবিধা, অপ্রতুল অবকাঠামো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবকিছুর মাঝেই মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষাই তার কাজ।

সেই দুর্যোগময় জুলাইয়ের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ এক গর্ভবতী নারী ভর্তি হন শরণার্থী শিবিরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। মাত্র ৩০ মিনিটেই তিনি প্রথম যমজ সন্তান প্রসব করেন, কিন্তু শুরু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। বিদ্যুৎ নেই, হাঁটুসমান পানি স্বাস্থ্যকেন্দ্রজুড়ে, চিকিৎসার সরঞ্জাম ও ওষুধ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। এক মুহূর্ত দেরি হলে মা বা শিশুর জীবন হতে পারতো বিপন্ন।

ধাত্রী শাকিলা সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জরুরি সিজারিয়ান সিদ্ধান্ত নেন। রক্ত দিয়ে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল রাখার পর ইউএনএফপিএ-র গাড়িতে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে।

এই একটিমাত্র ঘটনা নয়। বরং শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিনই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন শাকিলা ও তার মতো অনেক ধাত্রী। দুর্যোগ, গরম, রোগজর্জর পরিবেশ সবকিছুর মাঝেই তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রাণ, বেঁচে যাচ্ছে মা।


ছবি-ইউনিসেফ

তারা মনে করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু ক্ষতি কমানো যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা যেন থেমে না যায়, তা নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য।

শাকিলার মতো ধাত্রীরা শুধু একটি শিশুর জন্মের সময় পাশে থাকেন না, বরং গর্ভধারণের আগ থেকে শুরু করে প্রসব-পরবর্তী ৪২ দিন পর্যন্ত মায়ের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন। গর্ভকালীন জটিলতা চিহ্নিত করা, পরিকল্পনা নেওয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, মা ও নবজাতকের মানসিক সমর্থন সবই একজন ধাত্রীর দায়িত্ব।

বাংলাদেশে ধাত্রী সেবার উন্নতি দ্রুত ঘটছে। ২০১১ সালে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে প্রসবের হার ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে। এই উন্নতির পেছনে নিরলস পরিশ্রম করছেন শাকিলার মতো অসংখ্য অজানা মুখ।

বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিবছর ৫ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস। এই দিনে ধাত্রীদের অবদানকে স্বীকৃতি জানানো হয়। এই পেশাটি শুধু একটি চাকরি নয়, এ এক মানবিক ব্রত। প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনা, গর্ভকালীন জটিলতা নিরসন এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে ধাত্রীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্রতিদিনের কাজের শেষে যখন একটি শিশু মায়ের কোল জুড়ে আসে, সুস্থভাবে হাসে তখন শাকিলার মতো ধাত্রীরা বুঝতে পারেন, তাদের শ্রম বৃথা যায়নি। সৃষ্টির এই মুহূর্তগুলোই যেন তাদের ক্লান্তিকে মুছে দেয়, সাহস জোগায় পরের দিনের আরও কঠিন দায়িত্বের জন্য।

এই নিবেদিতপ্রাণ নারীদের জন্যই শত প্রতিকূলতাতেও নতুন প্রাণ আসে পৃথিবীতে, মায়েরা সুস্থ থাকেন, সমাজ এগিয়ে চলে। ধাত্রীদের শ্রম ও ত্যাগকে সম্মান জানাতে হলে শুধু প্রশংসাই নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে তাদের প্রণোদনা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।

আজ ধাত্রী দিবসে আমরা সেই সাহসী নারীদের কুর্নিশ জানাই, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রসূতি মায়েদের জীবনের আলো দেখান। কারণ জন্ম মানেই নতুন সূচনা, আর সেই সূচনার প্রহরী হচ্ছেন আমাদের ধাত্রীরা।

তথ্যসূত্র: ইউএনএফপিএ

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।
Exit mobile version