Site icon Amra Moulvibazari

পাঠ্যবই পেতেই মার্চ-এপ্রিল, কেমন হবে শিক্ষাপঞ্জি

পাঠ্যবই পেতেই মার্চ-এপ্রিল, কেমন হবে শিক্ষাপঞ্জি


প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করতে প্রতি বছর শিক্ষাপঞ্জি প্রকাশ করে সরকার। তাতে কতদিন ক্লাস হবে ও কতদিন ছুটি হবে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। এবারও ২০২৫ সালের শিক্ষাপঞ্জির খসড়া তৈরি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে আগামী ১ জানুয়ারি শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে। জুনে অর্ধবার্ষিক ও নভেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে এ শিক্ষাপঞ্জি মেনে ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করা নিয়ে এখনই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-অভিভাবকরা।

কারণ হিসেবে তারা পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণে দেরির বিষয়টি সামনে এনেছেন। তাদের ভাষ্য, এবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে বেশি দেরি করছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিও এখনো সাতটি শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারেনি। ফলে বই ছাপিয়ে তা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে মার্চ-এপ্রিল গড়াবে। শিক্ষাবর্ষ শুরুর চারমাস পর শিক্ষার্থীরা বই হাতে পেলে শিক্ষাপঞ্জি লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।

যদিও এনসিটিবি বলছে, জানুয়ারির মধ্যে সম্ভব না হলেও তারা ফেব্রুয়ারির শুরুতে সব বই শিক্ষার্থীদের দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বই বিতরণ শেষ করতে তৎপর তারা।

যা আছে শিক্ষাপঞ্জির খসড়ায়

খসড়া শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, আগামী বছর (২০২৫) ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে ২৪ জুন, চলবে ১০ জুলাই পর্যন্ত। একই সময়ে দশম শ্রেণিতে প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা নেওয়া হবে। ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে অর্ধ-বার্ষিক ও প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে হবে।

আরও পড়ুন:

দশম শ্রেণিতে নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হবে ১৬ অক্টোবর। এ পরীক্ষা চলবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। একই সঙ্গে শিক্ষাপঞ্জিতে নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল ১০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।

ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে আগামী শিক্ষাবর্ষে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে ২০ নভেম্বর, যা চলবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ পরীক্ষার ফল ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। প্রত্যেকটি পরীক্ষা ১২ কর্মদিবসের মধ্যে শেষ করতে হবে বলেও শিক্ষাপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘প্রাথমিকের বই ডিসেম্বরে ছাপা হয়ে যাবে। মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই আগে ছাপানোর চেষ্টা করছি। সেটা সম্ভব হলে প্রাথমিকের ১০ কোটি ও মাধ্যমিকের ১০ কোটি বই ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের দেওয়া যাবে। বাকি বইগুলো পরে দেওয়া হবে।’- এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান

পাঠ্যবই ছাপা কতদূর

সরকার পরিবর্তনের পর এনসিটিবিতেও পরিবর্তন এসেছে। এপ্রিল-মে মাস থেকে যেখানে বই ছাপা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়, সেখানে এবার এনসিটিবি এ কাজ পুনরায় শুরু করেছে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। নভেম্বরে আগের টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সব মিলিয়ে ৪০ কোটিরও বেশি বই ছাপার কাজে অনেক পিছিয়ে পড়ে সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি।

তারপরও এনসিটিবির পরিকল্পনা ছিল, বছরের শুরুতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে কিছু বই (অন্তত তিনটি) তুলে দেওয়ার। জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। নতুন বছর শুরুর মাত্র ১৪ দিন বাকি। ফলে সেটি আর সম্ভব নয় বলে স্বীকার করেন খোদ এনসিটিবি কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন:

এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, শুধু প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ তিন শ্রেণির বই ছাপা শেষ হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই এখনো ছাপা শুরু করা যায়নি। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই এখনো ছাপাখানায় পাঠানো যায়নি। নবম-দশম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার ক্রয় কমিটিতে গত ১১ ডিসেম্বর অনুমোদন হলেও নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ডের (নোয়া) কাজ বাকি।

দ্রুত সব প্রক্রিয়া শেষ করতে পারলে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার কাজ ডিসেম্বরের শেষে শুরু হতে পারে। তবে কোনোভাবেই অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বই ডিসেম্বরে ছাপা শুরু করা সম্ভব নয়। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার (পিপিআর) শর্তানুযায়ী কাজ করতে গেলে এ তিন শ্রেণির বই ছাপা শেষ করে বিতরণ করতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, প্রাথমিকের বই ডিসেম্বরে ছাপা হয়ে যাবে। মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই আগে ছাপানোর চেষ্টা করছি। সেটা সম্ভব হলে প্রাথমিকের ১০ কোটি ও মাধ্যমিকের ১০ কোটি বই ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের দেওয়া যাবে। বাকি বইগুলো পরে দেওয়া হবে।

‘বই ছাড়া ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীরা আসেও না। শিক্ষার্থীরা যখন বই হাতে পাবে, তখন থেকেই কেবল পুরোদমে ক্লাস নেওয়া সম্ভব।’- মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. সিরাজ উদ্দিন

বই দেরিতে পেলে শিক্ষাপঞ্জিতে কী প্রভাব পড়বে?

বিগত বছরগুলোতে ১ জানুয়ারি অধিকাংশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই হাতে পেয়েছে। বছরের প্রথম মাসের ১৫ দিন হেলাফেলায় কাটলেও জানুয়ারির ১৫ তারিখের পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়।

তবে এবারের চিত্র ভিন্ন ঘটতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা শিক্ষকদের। তারা জানান, বই হাতে না পেলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে চাইবে না। আর যারা আসবে, তাদেরও ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। বই ছাড়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসানো কষ্টসাধ্য।

আরও পড়ুন:

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখায় ১৬ বছর ধরে কর্মরত জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. সিরাজ উদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বই ছাড়া ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীরা আসেও না। শিক্ষার্থীরা যখন বই হাতে পাবে, তখন থেকেই কেবল পুরোদমে ক্লাস নেওয়া সম্ভব। পত্র-পত্রিকায় যে খবর দেখছি, তাতে তো মার্চের আগে এবার সব বই শিক্ষার্থীরা পাবে বলে মনে হয় না। সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শাখার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হাফসা আক্তার মায়া। তার মা রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ালেখা কিছুই হয়নি। সেভেনে তো নতুন শিক্ষাক্রমে কিছু পড়েছে, পরে আবার তা চেঞ্জ হয়ে গেছে। অষ্টম শ্রেণিতেও যদি বই সময় মতো না পায়, পড়তে না পারে; তাহলে ওদের ভিত মজবুত হবে কীভাবে? এক বছর পর ক্লাস নাইনে উঠবে। তারপর এসএসসি।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের তো মাথাব্যথা নেই। যত টেনশন অভিভাবকের। বইগুলো ছাপানোর কাজ হচ্ছে না। অনুমোদন নিয়ে নাকি দেরি? এখন তো নিরপেক্ষ সরকার। তারা কেন এত দেরি করছে?’

‘শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যদি মাউশি অথবা এনসিটিবি থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে সেটা মেনে আমরা কাজ করবো।’- মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহেলা নাসরিন

মার্চে রোজা-ঈদ, জুনে গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটি

ছাপাখানার মালিকরা বলছেন, এপ্রিলের আগে সব বই ছাপার কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। আর এনসিটিবির দাবি—ফেব্রুয়ারির মধ্যে তারা বই দিতে পারবে। যদি এনসিটিবি ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীর হাতেও দেয়, তবুও তা কাজে আসবে না। কারণ শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী—রমজান, ঈদুল ফিতরসহ কয়েকটি ছুটি মিলিয়ে ২ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৩৮ দিন (সাপ্তাহিক ছুটিসহ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) আহসান উল্যাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছুটি যদি সরকার কাটছাট না করে তাহলে ওই সময়ে তো ক্লাস হবে না। এপ্রিলের ১০ তারিখের আগে পুরোদমে ক্লাস নেওয়াও সম্ভব হবে না।’

আরও পড়ুন:

এদিকে, শিক্ষার্থীরা যদি সব বই পাওয়ার পর এপ্রিলে পুরোদমে ক্লাসে বসে, তাতেও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আগে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ শিক্ষাপঞ্জিতে ১ জুন থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ১৯ দিন (সাপ্তাহিক ছুটিসহ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ ও ঈদুল আজহার ছুটি চলবে। স্কুল খুলেই ২৪ জুন থেকে শুরু হবে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা।

মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহেলা নাসরিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বই পেতে দেরি হলে রোজার আগে বেশি ক্লাস নেওয়া সম্ভব হবে না। আবার রোজা-ঈদের ছুটির পর দেড়মাস ক্লাস করেই গরমের ছুটি, কোরবানির ঈদের ছুটি। ঝামেলা থাকছেই। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যদি মাউশি অথবা এনসিটিবি থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে সেটা মেনে আমরা কাজ করবো।’

‘শিক্ষাপঞ্জির প্রস্তাবিত কপিটি আমি দেখেছি। সেটা কিন্তু এখনো অনুমোদন দেইনি। সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষাপঞ্জিতে কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব কি না, তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের

যা বলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি

বই ছাপায় দেরি হওয়ার পেছনে পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে দায়ী করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিছুটা দেরিতে বই দেওয়া হলেও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাপঞ্জির প্রস্তাবিত কপিটি আমি দেখেছি। সেটা কিন্তু আমরা এখনো অনুমোদন দেইনি। সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষাপঞ্জিতে কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব কি না, তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় যে ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাদের আমরা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবো।’

আরও পড়ুন:

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দেয়, তা বাস্তবায়নে কাজ করে তারা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়গুলো আমরাও অবগত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমাদের পক্ষ থেকে আলোচনাও তোলা হয়েছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যে নির্দেশনা দেবে, তা বাস্তবায়নে কাজ করবো আমরা।’

এএএইচ/এমএমএআর/এমএস

Exit mobile version