গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার। তিনি বলেছেন, কেবিনেট মিটিংয়ে আহত ও শহীদ পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জুলাই বিপ্লব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আয়োজিত ২০২৪ জাতীয় পর্যায়ের এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন এই সেমিনারের আয়োজন করে।
ফরিদা আক্তার আরও জানান, গণঅভ্যুত্থনের পক্ষে আহতদের অঙ্গহানির জন্য তাদের যারা তিরস্কার বা কটু কথা দ্বারা মানসিক আঘাত দেয় তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না। আমরা দেখেছি আন্দোলনের পর থেকে অনেক মা-বাবারাও ট্রমাটাইজড। অনেক পরিবারের মেয়েরা আন্দোলনে ট্রমাটাইজড হয়ে লোক ভয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন না এই ভয়ে যে, যদি মানুষ জেনে যায় তাহলে তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হতে পারে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, দেশের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা অবহেলিত। নব্বই শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চিকিৎসা বঞ্চিত। চিকিৎসার সুব্যবস্থাও তেমন নেই। এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। তারা বলেন জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আহত এবং নিহত পরিবারও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আহতরা যে পক্ষের হোক তারা চিকিৎসা পাবেন। তবে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অর্ধেককে এখনো সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সব গুছিয়ে নিতে। আমরা নিশ্চিত করছি তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সার্বিক প্রয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম. মুজাহেরুল হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ছাড়াও আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নানারকম হতাশায় ভুগছেন। তারা একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছেন না। তাদের আবারও সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরিয়ে আনতে হলে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তারা যে মানসিক অবসাদে ভুগছেন তা কাটিয়ে উঠতে তাদেরকে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহী করতে হবে এবং তারা সঠিক চিকিৎসা পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চরকির সিইও রেদওয়ান রনি জানান, আন্দোলনের তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়েও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন আন্দোলনের ভয়াবহতায়। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় আন্দোলনকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতায় পরিকল্পনা থাকা উচিত।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড হেল্পলাইনের পরিচালক মো. মোহাইমিন চৌধুরী বলেন, আন্দোলনকালীন সময় থেকে চাইল্ড হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা বেড়ে যায়। যারা সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে এবং এই সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তাদের অনেকেই এখন খাওয়া-দাওয়া করতে পারছে না, ঘুমোতে পারছে না। কারণ তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে এবং এই হতাশা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট হেল্পলাইন সহযোগিতা করবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগের গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ১ হাজার ৪২৩ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, আহতদের সংখ্যা ২২ হাজারেরও বেশি, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোর।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম ও জটিল একটি রোগ- পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, যেটাকে সংক্ষেপে ‘পিটিএসডি’ বলা হয়। তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত থেকে এ সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে অনেক সময়ই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এর মাঝে অনেকেই কারণ থাকুক বা না থাকুক বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভুগতে পারেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা শুরু করতে পারেন।
এএএম/কেএএ/