কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ ও তাড়াইলে প্রায় ৩৮ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু। এমপি থেকে মন্ত্রী সবই হয়েছেন। তবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সখ্য এনে দিয়েছে পার্টির মহাসচিব পদসহ বিপুল অর্থবিত্ত।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকা ও নিজ এলাকায় হাজার কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন চুন্নু। কানাডা, দুবাই ও মালয়েশিয়ায় অর্থপাচার করে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
২০০১ সালে মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাচন করেছিলেন মানুষের টাকায়। নিজেকে অসহায় দাবি করে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি মানুষের কাছে টাকা চাইতেন। গণসংযোগের সময় গলায় সুতা ঝুলিয়ে রাখতেন, মানুষ সেখানে ২ টাকার নোট থেকে শুরু করে ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট গেঁথে দিতেন।
এমপির দাপট দিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনরাও টাকা কামিয়েছেন দুই হাতে। ভাই-ভাতিজারা নিয়ন্ত্রণ করেছে এলাকার সবকিছু। সব ধরনের ডিলারশিপসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা তারাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। তাদেরই পকেটের লোকজন পেয়েছে নানান সুবিধা। যাবতীয় অপকর্ম, ভাগ বাটোয়ারা তার মামাতো ভাই ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) বাবলুর মাধ্যমে সমন্বয় করতেন চুন্নু।
মুজিবুল হক চুন্নুর কুটকৌশলে বারবার ধরাশায়ী হয়েছে করিমগঞ্জ-তাড়াইলের আওয়ামী লীগও। দলে বিভক্তি তৈরি করে দুই হাতে ফায়দা লুটেছেন তিনি। বিএনপির একটি অংশের সঙ্গেও ছিল চুন্নুর গভীর সখ্য। নরমে গরমে কিংবা সুবিধা দিয়ে বশ করে রেখেছিলেন সবাইকে। এক কথায় করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মুজিবুল হক চুন্নু ছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক নাম। তার সমকক্ষ বা তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ ছিল না।
জাপা মহাসচিবের হলফনামায় দেওয়া হিসাব মতে, গত ১৫ বছরে তার নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩৭ গুণ। তবে চুন্নুর প্রতিপক্ষ শিবিরের অভিযোগ, হলফনামায় তার সহায়-সম্পত্তির এক শতাংশও দেখানো হয়নি। তাদের দাবি, ২০০৮ সালের পর থেকে তিনি অবৈধভাবে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। একটি সূত্র জানিয়েছে, কানাডায় তার রয়েছে চারটি আলিশান বাড়ি। এছাড়া মালয়েশিয়ায় রয়েছে একাধিক বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ভোট চুরি দিয়ে অভিষেক
১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় রাজনীতিতে অভিষেক হয় মুজিবুল হক চুন্নুর। তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-৪ (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-৩) আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে এমপি হন তিনি। তবে ওই নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট চুরির অভিযোগ আছে। নিজ এলাকা তাড়াইলে ভোট চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন তার ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম। এরপরও নির্বাচনে তাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয় পায়। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন। তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দুই বছর পর ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। তবে এ আসন থেকে জাপার প্রার্থী হয়ে চুন্নু দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হন। তখনও তার বিরুদ্ধে ভোটে কারচুপির অভিযোগ ছিল। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে পাত্তা পাননি চুন্নু। তখন তিনি পেয়েছেন মাত্র ১৭ হাজার ৯৫২ ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. মিজানুল হক ৪৫ হাজার ৬০৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। নিকটতম প্রার্থী ছিলেন বিএনপির কবিরউদ্দিন আহম্মদ। তিনি পান ৩৯ হাজার ৫৫৪ ভোট। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মিজানুল হকের কাছে হেরে যান চুন্নু। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ড. ওসমান ফারুক বিজয়ী হন। এসময় চুন্নু হন তৃতীয়। তবে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের টানা চারটি নির্বাচনে তিনি জয়ী হন বিভিন্ন কৌশলে। যদিও শেষের তিনটি নির্বাচনে চুন্নু জয়ী হতে ব্যাপক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এই নির্বাচনগুলো ভোট ডাকাতির ও রাতের ভোটের নির্বাচন ছিল বলে অভিযোগ আছে। এসব নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী ছিলেন। এ কারণে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না।
চুন্নুর কুটকৌশলে বারবার ধরাশায়ী হয়েছে করিমগঞ্জ-তাড়াইলের আওয়ামী লীগও। দলটি বিভক্তি তৈরি করে দুই হাতে ফায়দা লুটেছেন তিনি। বিএনপির একটি অংশের সঙ্গেও ছিল চুন্নুর গভীর সখ্য। নরমে গরমে কিংবা সুবিধা দিয়ে বশ করে রেখেছিলেন সবাইকে। এক কথায় করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মুজিবুল হক চুন্নু ছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক নাম। তার সমকক্ষ বা তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ ছিল না।
করিমগঞ্জ সদরের আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘চুন্নুর কারণে করিমগঞ্জ আওয়ামী লীগ ১৫ বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ২০০৮ সাল বাদে সবগুলো নির্বাচনে তিনি জোর করে জয়ী হয়েছেন। ’৮৬ ও ’৮৮ নির্বাচন তো ছিল রীতিমতো ভোট ডাকাতি।
শূন্য থেকে বিপুল অর্থবিত্ত
এলাকাবাসী জানান, ২০০১ সালে মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাচন করেছিলেন মানুষের টাকায়। নিজেকে অসহায় দাবি করে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি মানুষের কাছে টাকা চাইতেন। গণসংযোগের সময় গলায় সুতা ঝুলিয়ে রাখতেন, মানুষ সেখানে ২ টাকার নোট থেকে শুরু করে ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট গেঁথে দিতেন।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া মুজিবুল হক চুন্নুর হলফনামা ঘেঁটে জানা গেছে, ২০০৮ সালে তার পেশা ছিল আইন ব্যবসা। একটি বাসের মালিকানাও ছিল তার। তখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের নামে জমা ছিল ৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে জমা ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। দুজনের হাতে নগদ ছিল ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৭২৪ টাকা। গত নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী চুন্নু নিজে ৩ কোটি ৪১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৩ ও স্ত্রী ১১ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৪ টাকার মালিক। ২০০৮ সালে তাদের কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। এখন তাদের কাছে রয়েছে ৪৬ হাজার ৪৩৩ মার্কিন ডলার। বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে আছে ৯৭ লাখ ২১ হাজার ৫৮৪ টাকা। দুজনের নামে ১২ একর কৃষি ও অকৃষি জমি। পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট ও গ্রামের বাড়ি কাজলায় তিনতলা পাকা ভবন।
আমি রাজনীতি করেছি মানুষের জন্য। ক্ষমতায় থাকাকালে করিমগঞ্জ-তাড়াইলে কাউকে হয়রানি করিনি। কারও নামে কোনো মামলা করিনি। জাতীয় পার্টি দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে। রাষ্ট্র সংস্কারে আমরা এ সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। এখন আমাদের বিরুদ্ধে যদি ষড়যন্ত্র করা হয় এটা দুঃখজনক। —মুজিবুল হক চুন্নু
জাপা মহাসচিবের হলফনামায় দেওয়া হিসাব মতে, গত ১৫ বছরে তার নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩৭ গুণ। তবে চুন্নুর প্রতিপক্ষ শিবিরের অভিযোগ, হলফনামায় তার সহায়-সম্পত্তির এক শতাংশও দেখানো হয়নি। তাদের দাবি, ২০০৮ সালের পর থেকে তিনি অবৈধভাবে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। একটি সূত্র জানিয়েছে, কানাডায় তার রয়েছে চারটি আলিশান বাড়ি। এছাড়াও মালয়েশিয়ায় রয়েছে একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
দেশেও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেয়ার ব্যবসায় রয়েছেন। ঢাকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হোল্ডিংস লিমিটেডসহ বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বনানী উত্তরা ও গুলশানে তিনি একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছিলেন বলে জানা গেছে। তবে অ্যাসেট থেকে কেনা উত্তরার ফ্ল্যাটটি বিক্রি করেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া নামে-বেনামে ঢাকায় রয়েছে তার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যে ব্যক্তি এক সময় লোকজনের আর্থিক সহায়তা নিয়ে নির্বাচন করেছেন, তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। স্থানীয়দের মুখে মুখে আজ যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, সেগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
চুন্নুর গ্রামের বাড়ি তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের কাজলা গ্রামে। ওই গ্রামের বাসিন্দা আরাফাত হোসেন মুরাদ বলেন, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ঐকমত্যে র সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর পদ পান চুন্নু। মূলত মন্ত্রী হওয়ার পর অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকেন তিনি। কলকারখানা ও পোশাকশিল্প থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন এই জাপা নেতা। কাজলা গ্রামে চুন্নুর তিনতলা বাসভবনের সামনে গিয়ে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। বাসার সামনে বৈঠকখানাটিও অযত্ম-অবহেলার ছাপ। তিনি বাড়িতে গেলে এ বৈঠকখানায়ই নেতাকর্মী, এলাকাবাসী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাবর্তা বলতেন।
চুন্নুর সেই আলোচিত নির্বাচনী পোস্টার-সংগৃহীত ছবি
বাড়ির উল্টো দিকে চুন্নুর শখের ফলের বাগানে কাজ করছিলেন স্থানীয় এক শ্রমিক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রামে আর আসেননি তিনি। বাড়িটি বলতে গেলে ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হলে তারা চুন্নু সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ‘এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট প্রচুর করেছেন তিনি। তবে এসব থেকে ‘মারিংকাটিংও’ করেছেন প্রচুর। কমিশন ছাড়া ঠিকাদাররা কোনো কাজ করতে পারত না। অভিযোগ রয়েছে, করিমগঞ্জ তাড়াইলে ১৫ বছরে যত কাজ হয়েছে সব চুন্নু তার ‘নিয়োগকৃত’ ঠিকাদারদের দিয়ে করিয়েছেন। এসব ঠিকাদারিতে চুন্নু হয় শেয়ার থাকতেন নয় অগ্রিম কমিশন নিয়ে নিতেন। যে কারণে করিমগঞ্জ তাড়াইলের সব কাজ নিম্নমানের হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এলাকায় প্রচলিত আছে, যত কাজ হয়েছে তত টাকা কামিয়েছেন চুন্নু।
নদী ও হাওর ভরাট করে বাজার
বাজারের নাম চৌগাংগা নরসুন্দা নতুন বাজার। এর অবস্থান জেলার তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নে। ২০১১ সাল থেকে বাজার সৃজনের কাজ শুরু হয়। নরসুন্দা ও ঘরভাঙ্গা নদী এবং হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বাজারটি করা হয়েছে। বাজারের আয়তন কমবেশি ১০ একর। এখানে বর্তমানে চার শতাধিক ভিটা রয়েছে। বেশিরভাগ ভিটায় দোকানপাট তোলা হয়েছে।
ইটনা উপজেলার চৌগাংগা গ্রামের তাপস চন্দ্র বর্মন, বিকাশ চন্দ্র বর্মণ ও বিধান চন্দ্র বর্মণ-তারা তিন ভাই। বাজারের জন্য এই তিন ভাইয়ের মালিকানাধীন হাওরের সাত একর জমিতে চোখ পড়ে মুজিবুল হক চুন্নুর। অভিযোগ রয়েছে, চাপে ফেলে পানির দামে তাদের জমি নিজের লোকজন দিয়ে কিনে নেন মুজিবুল হক চুন্নু। প্রতি শতাংশ জমির দাম ধরা হয় আড়াই হাজার টাকা। এখন জমির মালিকদের বসতভিটা ছাড়া কিছুই নেই। তাপস বর্মণ স্থানীয় বাজারে চ্যাপার ব্যবসা করেন। স্থানীয়রা জানান, নতুন বাজার তৈরি করাসহ পুরো প্রক্রিয়ার প্রধান ব্যক্তি মুজিবুল হক চুন্নু। নিজের লোকজনকে দিয়ে মাত্র ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করিয়ে বাজার তৈরি করে সেখান থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা কামিয়ে নেন মুজিবুল হক চুন্নু।
অসহায় হিন্দু তিন ভাইয়ের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা শতাংশ করে জমি কিনে বাজার উঠিয়ে কমিটির মাধ্যমে ভিটা কেনাবেচা করে এসব টাকা নেন চুন্নু।
এই বাজারে মুজিবুল হক চুন্নুর বর্তমানে আটটি ভিটা রয়েছে। জানা গেছে, এগুলোও বিনামূল্যে পেয়েছেন তিনি। কারও মতে, নামমাত্র দামে। নদী ও হাওরের নিচু শ্রেণির জমি ভরাট করা অবৈধ হলেও এই বাজার তৈরিতে এখানে কোনো আইন মানা হয়নি। ১৫ থেকে ২০ ফুট বালু ফেলে দ্বীপের মতো জায়গাটি ভাসানো হয়।
এলাকার মোশাররফ হোসেন জানান, প্রথম দিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। পরে চুন্নুর প্রভাব বা হস্তক্ষেপের কারণে এসব আপত্তি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এরপর বাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়নে দু’হাতে সরকারি সহযোগিতা করেন চুন্নু।
বিচ্ছিন্ন বাজারটি মূল ভূমির সঙ্গে যুক্ত করতে ২০২০ সালে ৬০ মিটার লম্বা আরসিসি একটি ব্রিজ নির্মাণ করেন। পুরো বাজারে মোট ৯টি আরসিসি সড়ক নির্মাণ করা হয়। এলজিইডি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। করা হয় বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। এতে সব মিলিয়ে ১০-১২ কোটি টাকা খরচ হয় বলে জানা গেছে। বাজারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন চুন্নুর ছোট ভাই নজরুল হক নান্নু। চুন্নুই তাকে সভাপতি বানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চৌগাংগা বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, জমির মালিকদের ৫০ শতাংশ জমি দিয়ে মার্কেট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পরে কমিটির লোকজন সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। সরকারি টাকায় বাজার উন্নয়ন করা হলেও এ বাজার থেকে সরকার এক টাকাও পায় না। ১৩ সদস্যের কমিটি বাজারের ভিটাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মাধ্যমেই এগুলো কেনাবেচা হয়। মূল সড়কের পাশের ভিটাগুলো বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় হাতবদল হচ্ছে। কমিটির লোকজনের কাছেই সিংহভাগ ভিটার মালিকানা ছিল।
বাজারের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম রেনু ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মানিক নদী ভরাটের কথা অস্বীকার করেন। তবে তারা নিচু জমি ভরাট করে শ্রেণি পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেন। বাজার সৃষ্টির পেছনে সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর সহযোগিতা ও অবদানের কথাও জানান তারা। তবে দুজনই দাবি করেন, চুন্নু এ বাজার থেকে টাকা কামাননি। চুন্নুকে বিনামূল্যে ভিটা দেওয়া হয়নি। এগুলো তিনি কিনে নিয়েছেন।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, চুন্নু অবৈধভাবে এ বাজার তৈরি করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। এই বাণিজ্যের দ্বিতীয় উপকারভোগী তার স্বজনরা। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী একেকটি ভিটার দাম স্থানভেদে ৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য
ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা-২০০৯ অনুযায়ী, মন্ত্রী ও এমপিরা একাধিক মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সভাপতি হতে পারতেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুজিবুল হক চুন্নু করিমগঞ্জ ও তাড়াইলের প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়েছেন। এর মধ্যে করিমগঞ্জ কলেজ, করিমগঞ্জ ছোবহানিয়া ফাজিল মাদরাসা, করিমগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, তাড়াইলের মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, দামিহা উদয়ন কলেজ অন্যতম।
সূত্র জানায়, তিনি কমপক্ষে ১৫টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। দুই উপজেলায় বাকিসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন তার লোকজন। তিনি সভাপতি থাকাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি নিয়োগ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুস নিয়েছেন। যদিও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা এ অভিযোগ মানতে নারাজ। তবে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগ, চুন্নুর আমলে টাকা ছাড়া একটি নিয়োগও হয়নি। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ পদ। এসব পদে ৮ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, শুধু ১৫টি প্রতিষ্ঠান থেকেই মুজিবুল হক চুন্নু নিয়োগ, বদলি ও অন্য খাত থেকে কামিয়েছেন ৩০ কোটি টাকার ওপরে।
ভাই-ভাতিজাদের রাজত্ব
মুজিবুল হক চুন্নুর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের কাজলা গ্রামে। গ্রামটি বিশাল বড়। দামিহা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে এ গ্রামের লোকজন যাকে ভোট দেয়, তিনিই সাধারণত নির্বাচিত হন। চুন্নু দীর্ঘদিন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণে এলোকাটি তার ভাই-ভাতিজাদের রাজত্ব হয়ে ওঠে। মূলত ছোট ভাই নজরুল হক নান্নু এলাকার সব অপকর্মের নেতৃত্ব দেন। নান্নু পেশায় স্কুলশিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। এলাকায় এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, সেখানে তার অনৈতিক প্রভাব ছিল না। কাজলা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। অবসরে যাওয়ার ৯ মাস আগে ভাই চুন্নুর প্রভাব খাটিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি নেন। শিক্ষক থাকাকালে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি টানা ১৪ বছর সভাপতি ছিলেন কাজলা আলিম মাদরাসায়। এ সময়ে অন্তত ২০টি নিয়োগ হয় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই মাদরাসার নিয়োগ থেকে অন্তত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন তিনি। মাদরাসার বিপুল পরিমাণ মূল্যবান গাছ কেটে বিক্রির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
তাছাড়া তিনি তাড়াইল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অনেক বছর। বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন প্রকাশনীর বই বিক্রি, প্রশ্নপত্র বিক্রি করেও লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে কামিয়েছেন নান্নু। চৌগাংগা সিএনজি অটোরিকশা সমিতিরও সভাপতি তিনি। সেখান থেকেও নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা পান। তিনি যে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, কাজলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন তারই বড় ভাই মাহবুবুল হক ওয়াহিদ। এ বিদ্যালয়েও অন্তত ৭টি নিয়োগ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়েছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুজিবুল হক চুন্নু মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। বড় ভাই মাহবুবুল হক ওয়াহিদ একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। চুন্নু প্রভাব খাটিয়ে তাকেও মুক্তিযোদ্ধা বানান। বাবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে তার দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পান।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কাজলা গ্রামে ৭টি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই চুন্নুর ভাতিজা, ভাতিজাদের স্ত্রী কিংবা স্বজনরা প্রধান শিক্ষক! এসব স্কুলে যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিংবা অনুদান যেত সিংহভাগই আত্মসাৎ করা হতো। এলাকায় ব্যাপক প্রভাব থাকায় তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে হতো না।
চুন্নুর ভাই ও ভাতিজারা ভাগাভাগি করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি করেন। ভাতিজা একেএস জামান সম্রাট জাতীয় পার্টির নেতা ও জেলা পরিষদ সদস্য। চাচার ক্ষমতার সময় থানা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল তার। আরেক ভাতিজা এ কে এম মাইনুজ্জামান নবাব। দামিহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এলাকার টিআর কাবিখা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আরেক ভাতিজা মনিরুল হক আজাহার। জাতীয় পার্টির নেতা ও দামিহা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। এলাকার বাজার ও অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবসা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।
চুন্নুর আরও দুই ভাতিজা আতাউস সাত্তার মিরন ও আমির হামজা। তারা এলাকার টিসিবি ডিলার। শুধু টিসিবি নয়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, কৃষি সংক্রান্ত যত ডিলারশিপ আছে সব কিছুরই ডিলার তারা। স্থানীদের অভিযোগ, তারা (দুই ভাতিজা) নামে-বেনামে ভুয়া কার্ড তৈরি করে নিজেদের কাছেই রাখতেন। নানান অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বেশিরভাগ পণ্য বাজারে বিক্রি করতেন। এ কারণে অনেক সময় কার্ডধারী লোকজনও পণ্য পেত না। বিপুল প্রতাপ থাকায় লোকজন ভয়ে তাদের কিছু বলতে পারত না। এভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন ভাতিজা মিরন ও আমির হামজা। একবার মিরনের বিক্রি করে দেওয়া টিসিবি পণ্য নিয়ামতপুর বাজার থেকে উদ্ধার করে উপজেলা প্রশাসন।
কয়েকজন কৃষক জানান, চুন্নুর পুরো গ্রামে সাধারণ মানুষের বাড়িতে দু-তিনটি সাবমারসিবল পাম্প আছে কি না সন্দেহ রয়েছে। অথচ চুন্নুর ভাই-ভাতিজাদের ঘরে ঘরে সরকারি এ পাম্প বসানো হয়েছে। তাদের কারও কারও তিন-চারটি পাম্প রয়েছে। কারও গোয়ালঘরেও বসানো হয়েছে পাম্প। ভর্তুকিমূল্যে এলাকায় যে কয়টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবগুলো পেয়েছে ভাই-ভাতিজারা।
সালিশের নামে নজরুল হক নান্নুসহ তার ভাতিজারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সরকার পতনের পর তাদের অনেকে ঘাপটি মেরে আছেন।
তবে নজরুল হক নান্নুর ছেলে, মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ডের আসামি সাদ আল নাহিয়ানকে এলাকায় দেখা গেছে বলে স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন। সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এখন তিনি জামিনে আছেন বলে জানা গেছে। সাদ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে তখন পুলিশ জানিয়েছিল। জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি এলাকায় একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে এটি বন্ধ। নাহিয়ান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন বলে জানা গেছে। সব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেশ কয়েকবার নজরুল হক নান্নুকে ফোন দেওয়া হয়। তবে তিনি একবারও ফোন ধরেননি।
কম যাননি এপিএস বাবলু
পুরো নাম আমিরুল ইসলাম খান বাবলু। ছিলেন মুজিবুল হক চুন্নুর ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস)। তিনি চুন্নুর মামাতো ভাই। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও জাপা মহাসচিবের আগাধ আস্থা ছিল তার ওপর। এপিএসের মাধ্যমেই তিনি বড় বড় দুর্নীতি করেছেন বলে স্থানীয়রা বলেন। বিভিন্ন প্রকল্পের ভাগ বাটোয়ারা, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, বিশেষ প্রকল্প বণ্টন, সাবমারসিবল পাম্প বরাদ্দ, হাওরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধ বালু ব্যবসা, গরুর হাট নিয়ন্ত্রণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি সংশ্লিষ্ট ও কাবিখা প্রকল্পসহ দুই উপজেলার সবকিছু করানো হতো তাকে দিয়ে। প্রভাবশালী হিসেবে চুন্নুর পরই তার নামটি উচ্চারিত হতো। ব্যাপক দুর্নীতি করে চুন্নু যেমন দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন। তিনিও হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলা প্রশাসনে তার খবরদারি ছিল চোখে পড়ার মতো। তার তদবির বা নির্দেশনা কারও অবজ্ঞা করার সুযোগ বা সাহস ছিল না।
বাবলু আবার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দলটির যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য তিনি। আওয়ামী লীগ করেও তাড়াইল ও করিমগঞ্জে জাতীয় পার্টির কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন মূল অনুঘটের ভূমিকায়। পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা, চুন্নুর অনুসারী আওয়ামী লীগারদের দিয়ে পৃথক কর্মসূচি পালন, সেখানে আর্থিক অনুদান দেওয়া সবই তিনি করেছেন ‘নিষ্ঠার’ সঙ্গে। বাবলুর বাড়ি ইটনা উপজেলার রায়টুটি গ্রামে। চুন্নুর এপিএস হয়েও চুন্নুর নির্দেশে তিনি ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে করিমগঞ্জ-তাড়াইল আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি! চুন্নুর বিপক্ষে যেন নির্বাচনে কেউ দাঁড়াতে না পারে এর জন্যই চুন্নুর এই কৌশল ছিল।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, বাবলু জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর এপিএসের দায়িত্ব পালন করেন। একইসঙ্গে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কর্মসূচি বাস্তবায়নও তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেন। মূলত চুন্নুর সময় জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গিয়েছিল।
তাড়াইলের দামিহা উদয়ন কলেজটি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মুজিবুল হক চুন্নু। তিনিই দীর্ঘদিন কলেজের সভাপতি ছিলেন। পরে এপিএস বাবলুকে সভাপতি করা হয়। ২০১২ সালে এ কলেজে বাবলুর স্ত্রী নাজমুন নাহার জুঁইকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া নিবন্ধন তৈরি করে তাকে কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয়। যথারীতি এমপিওভুক্ত হন তিনি। তবে নিয়োগ পেয়েও তিনি কোনো দিন কলেজে ক্লাস করাননি। কিন্তু বেতন-ভাতা ঠিকই উঠিয়েছেন। অবশ্য গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন বলে জানিয়েছেন কলেজের আরেক প্রভাষক মাসুদুল আলম। দামিহা এলাকার কয়েকজন অভিযোগ করেন, এই কলেজের নামে কাবিখাসহ বহু প্রকল্প আনা হয়েছে। তবে এসব প্রকল্পের টাকা কলেজের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়নি। বেশিরভাগ প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তাদের দাবি, তদন্ত হলে সব দুর্নীতি ধরা পড়বে।
এপিএস বাবলুর সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগও ছিল হাতের মুঠোয়
জাতীয় পার্টির নেতা হলেও স্থানীয়ভাবে কৌশলে আওয়ামী লীগের লাগাম নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু। তার ব্যাপারে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রবল বিরোধিতা থাকলেও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এগুলো সফলভাবে সামাল দিয়েছেন তিনি। তাড়াইল ও করিমগঞ্জে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নিজের অনুগত সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করেছেন বহু বছর। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও দিনশেষে সবাই মাথা নত করেছে চুন্নুর কাছে। যাকে যেভাবে সম্ভব সেভাবেই ম্যানেজ করেছেন তিনি। এ দুই উপজেলায় গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ কার্যত তার গোলাম হয়ে কাজ করেছিল। তবে করিমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ঠুকাঠুকি হয়েছে। তবে দলে বিভক্তি থাকায় আওলাদ চুন্নুকে বেকায়দায় ফেলতে পারেননি কখনও। মনোনয়ন পেয়েও চুন্নুর কারণে বারবার নির্বাচনে ছাড় দিতে হয়েছে তাকে। এ কারণে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন চুন্নুর ওপর। কেবল আওয়ামী লীগকে কবজা নয়, বিএনপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সখ্য ছিল। ফলে এ দুই উপজেলা রাজনৈতিকভাবে প্রবল পরীক্ষায় পড়তে হয়নি তাকে। চুন্নুর আসনে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. এম ওসমান ফারুক। ২০০১ সালের নির্বাচনে চুন্নু তার কাছে ধরাশায়ী হন। এ কারণে ওসমান ফারুককে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাতে নানান ফন্দি আঁটেন।
অভিযোগ রয়েছে ড. এম ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সময়ের বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে মামলা হয় এটির পরিকল্পনা হয়েছিল চুন্নুর বাসায় বসেই।
করিমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চুন্নু করিমগঞ্জ আওয়ামী লীগে দু-তিনটি উপদল করে রাখতেন সবসময়। আবার সব গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগও রাখতেন তিনি। বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিজের সমর্থক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এছাড়া জোটের কারণে স্থানীয় নেতাকর্মীরা চুন্নুর বিরোধিতায় না গিয়ে, বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন।
চুন্নুর গ্রেফতার চায় সবাই
মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলার অভিযোগে গত ২৩ অক্টোবর করিমগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে ৬ অক্টোবর ছাত্র হত্যার দায়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় চুন্নুর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়। মামলাটি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির সময় গত ৫ আগস্ট রাজধানীর আজমপুর এলাকায় গুলিতে নিহত শহিদ আলমগীর হোসেনের (৩৪) মা মোছা. আলেয়া।
শেখ হাসিনার পতনের পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর ও ৩ অক্টোবর করিমগঞ্জে চুন্নুর গ্রেফতার দাবিতে ঝাড়ু মিছিল হয়। ওইসব মিছিলে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন।
চুন্নুর বিতর্কিত রাজনীতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন সরব।
গত ৭ নভেম্বর দুপুরে বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ, কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয় শহরের পুরান থানার ইসলামিয়া মার্কেটের সামনে। এ মানববন্ধনে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ বলেন, ‘মজিবুল হক চুন্নুর মত ফ্যাসিবাদের দোসরকে কিশোরগঞ্জের মানুষ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে, তার মতো লোককে কিশোরগঞ্জে রাজনীতি করতে দেবে না। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, তাদের দোসরদেরও বিচার হবে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর, তাদেরও বিচার হবে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশের মানুষ তাদের রাজনীতি করতে দেবে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম জাতীয় পার্টিকে স্বৈরাচার হাসিনার দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। গ্রেফতারে দাবি করছেন জাতীয় পার্টির দুই নেতা জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর।
এ পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে থাকলেও অনেকটাই চাপে রয়েছেন মুজিবুল হক চুন্নু।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমি রাজনীতি করেছি মানুষের জন্য। ক্ষমতায় থাকাকালে করিমগঞ্জ-তাড়াইলে কাউকে হয়রানি করিনি। কারও নামে কোনো মামলা করিনি। জাতীয় পার্টি দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে। রাষ্ট্র সংস্কারে আমরা এ সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। এখন আমাদের বিরুদ্ধে যদি ষড়যন্ত্র করা হয় এটা দুঃখজনক।’
কেআরএম/এসএইচএস/জিকেএস