Site icon Amra Moulvibazari

‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে বিএনপির আশঙ্কার নেপথ্যে কী?

‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে বিএনপির আশঙ্কার নেপথ্যে কী?


ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে ধোঁয়াশা ঘনীভূত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে আস্থার দোলাচল। নানা পক্ষের নানা বক্তব্যে সাধারণ মানুষও কোনো কিছু আঁচ করতে পারছে না। তবে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকটের আভাস পাচ্ছে মানুষ। ঠিক এমন সময়ই ‘কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এ বক্তব্য ঘিরে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে দল ও দলের বাইরে।

বিএনপি নেতারা তারেক রহমানের এ বক্তব্য খণ্ডনও করেছেন। তাদের ধারণা, জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করতে ‘কোনো একটি পক্ষ সক্রিয়’ হয়ে কাজ করছে। তারা মনে করেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এ কারণেই নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এমনকি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও কারও বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, বলছেন দলটির নেতারা।

এরই মধ্যে ভারতীয় একটি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা নিয়ে বিএনপির ভূমিকা’ বিষয়টি সামনে এনেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতার মন্তব্য নিয়েও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বিএনপিতে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, জরুরি সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে। তার দাবি, ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে’ বিএনপির কোনো ভূমিকা নেই।

তিনি বলেন, বিএনপি মনে করছে পতিত স্বৈরাচারের বিভিন্ন ফ্যাক্টর বিভিন্নভাবে নির্বাচন বিলম্বিত করতে সরকারকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে। এটিই ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিশন গঠন করেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার।

আরও পড়ুন

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’কে দেওয়া ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারটি গত সোমবার হিন্দু’র অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, এটি এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটি করেছে, বলেছে সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা এরই মধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করবো না।

ওই সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে তার সরকারের কোনো আপত্তি আছে কি না- জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, কোনো একটি দল বা আরেকটি দলকে বেছে নিতে আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করছি।

প্রধান উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের পর বুধবার ফেনীতে এ অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ নাকি আমরা দিচ্ছি। এ কথাটি সঠিক না।

তবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, এমনকি রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার ঘোর বিরোধী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর আগে সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে ছাত্র নেতাদের অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি। ফলে রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগের বিষয়টি আর এগোয়নি। অন্যদিকে বিএনপি মনে করে, সংবিধান সংস্কারে একটি কমিশন কাজ করলেও এটি বাস্তবায়ন করতে পারে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ।

রাজনৈতিক একজন বিশ্লেষকের বক্তব্য, চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির আশাহত হওয়ার মূল কারণ হলো নির্বাচন বিলম্বিত হলে বিএনপির ‘বর্তমান জনপ্রিয়তা’ এবং ‘পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ’ একই ধরনের না-ও থাকতে পারে। সে কারণেই ‘নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা’ তাদের কাছে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায় দেওয়া বক্তৃতায় তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেন, আমরা প্রায়ই বলি, ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। আপনারা নিশ্চয়ই গত কয়েক দিনের পত্র-পত্রিকার খবর থেকে বুঝতে পারছেন।…কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। কাজেই জনগণকে সচেতন করতে হবে, জনগণকে পাশে রাখতে হবে, জনগণের পাশে থাকতে হবে।

গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে ভোটের মাধ্যমে জবাবদিহি তৈরি হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন হয়েছেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে কোনো মূল্যে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তার এ বক্তব্যের পর ‘কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে’ -মন্তব্যটি আলোচনায় চলে আসে। যদিও তারেক রহমান ও দলটির নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারকে সহযোগিতার পাশাপাশি ‘দ্রুত নির্বাচন’ দাবি করে আসছেন। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। এমনকি বিএনপিকে ইঙ্গিত করেও বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিচ্ছেন তারা। এ বিষয়গুলোর দলটির নেতাদের নজর এড়াচ্ছে না।

একদিকে নির্বাচনের সময়সীমা অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ইস্যুতে সরকার পক্ষ ও বিএনপির বক্তব্যে বৈপরীত্য স্পষ্ট। বিএনপি সবসময় জরুরি সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসছে। তবে সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ চার বছর বা তারও কম হবে।

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে মঙ্গলবার দেওয়া পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেছেন, ছেলেদের রক্তের ওপর পা রেখে দিল্লিকে কিবলা বানিয়ে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জনগণের মুক্তির নিয়তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আওয়ামী পুনর্বাসনের জন্য যারা উদ্যোগ নেবে, তাদের ইতিহাস গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে।

এর আগে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ গত সোমবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলি, তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বক্তৃতায় সেটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিএনপিকে ইঙ্গিত করেই এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা রয়েছে জনমনে। বুধবার হাসনাত আব্দুল্লাহ বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, বিএনপি, জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী কোনো দলের সঙ্গেই শিক্ষার্থীদের ভেদাভেদ নেই। তাছাড়া, এই গণঅভ্যুত্থানের পরে একটি ব্যাপার দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে যে বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি কখনোই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। সুতরাং আমরা বিভাজনের বদলে ঐক্য চাই। অপশাসনের বদলে সুশাসন চাই।

ষড়যন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য ‘পতিত স্বৈরাচার’ এর নানা ফ্যাক্টর দেশে বিদেশে নানাভাবে চেষ্টা করছে এবং এটিকেই তার দল ‘ষড়যন্ত্র’ মনে করছে।

আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতে বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে প্রধান উপদেষ্টা যে মন্তব্য করেছেন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গণহত্যাসহ যেসব অপরাধ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতা শেখ হাসিনা করেছেন, সেজন্য তাদের বিচার হতে হবে।

আরও পড়ুন

‘সংবিধান অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাদেশের যে সংশোধনী আনা হচ্ছে তাতে এসব অপরাধে কোনো ব্যক্তি বা দল দোষী হলে নির্বাচনে তাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করার বিষয়টি তো আইনের বিষয়। তবে আমরা মনে করি আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি জনগণ ও আন্দোলনে যারা যারা ছিলেন তারা কী চান সেটাও দেখতে হবে। আমরা গণহত্যাসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাই। এ নিয়ে তো বিএনপির ওপর দোষ চাপানোর কিছু নেই’- বলেন সালাউদ্দিন আহমেদ।

ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ঘিরে বিএনপির সঙ্গে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি মনে করি ছাত্রনেতাদেরও তাদের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ করা দরকার, যেন বিএনপিসহ যারাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি তৈরির সুযোগ না হয়।

দলের মহাসচিব ফেনীর অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমরা বলেছি, আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক দল। কে রাজনীতি করবে, কে রাজনীতি করবে না, তা নির্ধারণ করবে জনগণ। সুতরাং, এখানে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, আমরা কখনোই কোনো দলকে নির্বাচন করতে মানা করিনি। কিন্তু যারা হত্যা করেছে, মানুষ খুন করেছে, অন্যায় করেছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করে বিদেশে পাঠিয়েছে, তাদের অবশ্যই দেশে এনে বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে রাজনীতি করতে দেবেন, কাকে দেবেন না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান চলমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলছেন, বিএনপির আকাঙ্ক্ষা ছিল দ্রুত নির্বাচন হলে ভোটের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় যাবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সরকার একটু বেশি সময় থাকতে চাইছে। ছাত্র সংগঠকরা ভোটের আগে ব্যাপক সংস্কার চাইছেন।

তার ভাষ্য, বিএনপির মধ্যে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ারও ভয় থাকতে পারে। তারা ভাবতে পারে এখন তাদের যে জনপ্রিয়তা সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে পারে। আর তেমন পরিস্থিতি তৈরি করতেই কোনো কোনো পক্ষ নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইতে পারে। তিনি মনে করেন, এমন আশঙ্কা থেকেই বিএনপি ষড়যন্ত্রের কথা বলছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমকেআর/এমএস

Exit mobile version