Site icon Amra Moulvibazari

বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন যিনি

বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন যিনি


‘স্বাধীন ফুটবল দল’- স্বাধীনতার জন্য ফুটবল খেলা, এমন একটি দল পৃথীবিতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানো, তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিদেশীদের, বিশেষ করে ভারতীয় জনগণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ফুটবল খেলে বেড়িয়েছিলো একটি দল। যাদেরকে বলা হতো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। তারাও ছিল, মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার, মুক্তিযোদ্ধা।

সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। ১৮ নভেম্বর, ২০২৪- জাকারিয়া পিন্টু নামক বাংলাদেশে ফুটবলের বটগাছটির জীবনাবসানের তারিখ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে গেলো। ৮১ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল দলের অধিনায়ক।

মোহাম্মদ জাকারিয়া পিন্টু, যাকে সবাই জাকারিয়া পিন্টু – হিসেবে একনামে চেনে। সারাজীবনটাই ব্যায় করেছেন ফুটবলের জন্য। তিনি সেই বিরল ফুটবলারদের একজন, যিনি পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দলের হয়ে খেলেছেন।

ফুটবলার হিসেবে ছিলেন তুখোড় ডিফেন্ডার। খেলার মাঠে প্রতিপেক্ষের স্ট্রাইকারদের আক্রমণ রুখে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার হতে পারলেও জীবন সায়াহ্নে এসে ডায়াবেটিসের সঙ্গে আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। এ জায়গা ডিফেন্ডার হতে গিয়ে হলেন ব্যর্থ।

আর সবারই জানা, ডায়াবেটিস মানেই অনেকগুলো রোগকে শরীরে বাসা বাধার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। জাকারিয়া পিন্টু এখানে হলেন ব্যর্থ এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন রোববার বিকেলে। সোমবার দুপুর হতে না হতেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

জন্ম এবং ফুটবল ক্যারিয়ার

১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নওগাঁ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। তবে বাল্যকালের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন বরিশালে। মঠবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে এসে ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ছিলেন কলেজ ফুটবল দলের অধিনায়ক।

১৯৬০ সালে এইচএসসি পাশ করে তিনি ভর্তি হন বরিশাল বিএম কলেজে। সেখানে থাকতেই অধিনায়ক হিসেবে জয় করেন শেরে বাংলা কাপের শিরোপা। ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে এসেও বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়ক হন পিন্টু। তার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ব পাকিস্তান দলে

১৯৬০ সালেই পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলেন জাকারিয়া পিন্টু। সেবার করাচিতে অনুষ্ঠিত ১১ম জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন তিনি। জহিরুল হকের নেতৃত্বে সেবার শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পিন্টু। ফাইনালে করাচি হোয়াইটসকে ১-০ গোলে হারায় পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দল।

১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন বিভাগভিত্তিক ফুটবল দল গঠন করে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রেরণ করে। পিন্টু প্রতিনিধিত্ব করেন খুলনা বিভাগের হয়ে। ১৯৬৩ সালে চীন জাতীয় ফুটবল দল সফরে এলে একটি প্রদর্শনী ম্যাচে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে অংশ নেন জাকারিয়া পিন্টু। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান হেরেছিলো ১-১১ গোলের বিশাল ব্যবধানে।

১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন পিন্টু। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে তার নেতৃত্বেই প্রথম সাফল্য আসে পূর্ব পাকিস্তান দলের। ১৯৭০ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত কিং মহেন্দ্র কাপের শিরোপা জয় করে পূর্ব পাকিস্তান।

পাকিস্তান জাতীয় দলে

১৯৬৯ সালে জাকারিয়া পিন্টু পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষিক্ত হন। সেবার ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত জাম-ই দোস্তি কাপে (ফ্রেন্ডশিপ কাপ) খেলে পাকিস্তান। ওই সময় সোভিয়েত ক্লাব স্পার্টাক মস্কো এবং তুর্কি ক্লাব মারসিম তালিক ইয়ুর্দুর বিপক্ষে খেলে পাকিস্তান। একইসঙ্গে ইরাক এবং ইরান জাতীয় দলের বিপক্ষেও ফুটবল খেলেন জাকারিয়া পিন্টুরা।

১৯৬৯ সালেই তুরস্কে অনুষ্ঠিত ১৯৬৯ আরসিডি কাপে অংশ নেন জাকারিয়া পিন্টু। এবার পিন্টুর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের আরও তিন ফুটবলার পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন। গোলাম সরাওয়ার টিপু, হাফিজুদ্দিন আহমেদ এবং খোন্দকার মোহাম্মদ নুরুন্নবি।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পশ্চিম বাংলার বালুঘাট ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও গোলাবরুদে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিও নিতে থাকেন। কিন্তু এ সময় তার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল তাকে পরামর্শ দেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দিতে। অস্থায়ী সরকারের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামও তাকে চিঠি দেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দেয়ার জন্য। এরপর তিনি রাজি হন এই দলের হয়ে খেলার জন্য।

এরপর পিন্টুকে কলকাতা নিয়ে যান তার স্ত্রী এবং আবদুল জলিল। সেখানে তিনি দলের অন্যদের সঙ্গে যোগ দেন। প্রাথমিকভাবে তাকেই দলের অধিনায়ক মনোনীত করা হয়। মোহামেডানে তার সতীর্থ প্রতাপ শঙ্কর হাজরাকে দায়িত্ব দেয়া হয় সহ-অধিনায়কের। ২৫ জুলাই ১৯৭১, নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

বিদেশের মাটিতে প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী

ম্যাচ শুরুর আগে নদীয় জেলা প্রশাসক ডিকে ঘোষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে জাকারিয়া পিন্টু বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর গৌরব অর্জন করেন। তিনিই প্রথম গর্বিত বাংলাদেশি, যিনি বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন ভেন্যুতে মোট ১৬টি ফুটবল ম্যাচ খেলেছিলো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

পতাকা উত্তোলনের সেই ঘটনা নিয়ে পিন্টু বলেছিলেন, ‘ডিসি (ডিকে ঘোষ) আমাদের ম্যানেজমেন্টকে বলেছিলেন যে, অধিনায়ক এবং খেলোয়াড়রা জাতীয় দলের পতাকা ওড়াবেন। কর্মকর্তারা নয়। ২৫ জুলাই আমরা আমাদের দেশের পতাকা প্রায় ৩০ হাজার ভারতবাসীর সামনে উড়িয়েছিলাম। বিদেশের মাটিতে সেটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর কোনো ঘটনা। আমরা কলকাতায় ফিরে আসার পর এই ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হতে শুনলাম এবং পুরো ভারতেই এটা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিলো। পরে জানলাম, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমাদেরকে পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেয়ায় ডিসি ডিকে ঘোষের চাকরি চলে যায়। তবে, পরে অবশ্য তাকে রিলিজ করে দেয়া হয়েছিলো।’

বাংলাদেশ দলে

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ ফুটবল দল। জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন অধিনায়ক। বাংলাদেশ একাদশ বনাম প্রেসিডেন্ট একাদশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচটি। ঢাকা স্টেডিয়ামে অবশ্য পিন্টুর দল ০-২ গোলে হেরেছিলো প্রেসিডেন্ট একাদশে। শেখ মুজিবুর রহমান নিজে উপস্থিত ছিলেন এই ম্যাচে।

১৯৭২ সালের ১৩ মে, চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে ভারতীয় ক্লাব মোহনবাগানের বিপক্ষে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে পিন্টুর ঢাকা একাদশ। ঢাকা স্টেডিয়ামে ৩৫ হাজারেরও বেশি দর্শকের সামনে ১-০ গোলে জয়লাভ করে ঢাকা একাদশ। কাজী সালাউদ্দিন করেন একমাত্র গোলটি। এছাড়াও আসামের গুয়াহাটিতে বরদোলোই ট্রফিতে রানার্সআপ ঢাকা একাদশের নেতৃত্ব দেন। ফাইনালে ঢাকা একাদশ ইস্ট বেঙ্গলের কাছে ৫-০ গোলে হেরেছিলো।

১৯৭৩ সালে কোচ সাহেব আলি পিন্টুকে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা করে দেন। সে সঙ্গে দলের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব দেন। এই সাহেব আলি আবার ছিলেন ঢাকা একাদশের কোচও। জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেয, মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে।

থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয়বার আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় পিন্টুর। আগেরবার পাকিস্তানের হয়ে। এবার স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে। ম্যাচটি শেষ হয় ২-২ গোলের ড্র-য়ে। যদিও টাইব্রেকারে বাংলাদেশ ৬-৫ গোলে হেরে যায়। মারদেকা কাপেই ১৩ আগস্ট প্রথম জয়ের দেখা পায় বাংলোদেশ। সিঙ্গাপুরকে হারায় ১-০ গোলে।

ক্লাব ফুটবলে

১৯৫৭ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার আগের বছর ঢাকা আসেন পিন্টু। দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব ইস্ট এন্ডের ট্রায়ালে অংশ নেন। ট্রায়ালে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে সরাসরি মূল দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। ক্লাবকে তিনি ১৯৫৭ এবং ৫৮ সালে তুলে দেন প্রথম বিভাগ ফুটবলে।

১৯৫৯ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে। যেখানে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান। আগাখান গোল্ড কাপের তৃতীয় রাউন্ডে তার নৈপুণ্যে সিন্ধ ইয়ংমেন্সের বিপক্ষে জয় পায় ওয়ান্ডারার্স। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে সিলনের কাছে হেরে যায় তারা।

১৯৬০ সালে তিনি এবং আবদুল গাফফার বালুচের নৈপুণ্যে মোহামেডানকে পেছনে ফেলে ঢাকা প্রথম বিভাগের শিরোপা জেতে ওয়ান্ডারার্স। ১৯৬০ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে ১৯৬১ সালে জাকারিয়া পিন্টু যোগ দেন ঢাকা মোহামেডান ক্লাবে। এই ক্লাবের হয়ে টানা ১৪ বছর খেলার পর ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম অনুষ্ঠিত ফুটবল লিগের শিরোপা জিতে অবসরের ঘোষণা দেন পিন্টু।

কোচ হিসেবে

ফুটবল ছেড়ে দেয়ার পর বাংলাদেশ কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন জাকারিয়া পিন্টু। দক্ষিণ কোরিয়া বি দলের কাছে ১-০ গোলে হারলো বাংলাদেশ।

১৯৯৫ সালে জাকারিয়া পিন্টু খেলাধুল ক্যাটাগরিতে পেলেন স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে পেয়েছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার ছিলেন মোহামেডানের নির্বাচিত পরিচালকও।

আইএইচএস/

Exit mobile version