Site icon Amra Moulvibazari

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১৪

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১৪


গোমতীর শূন্যস্রোত
ঠাকুরদা ও নাতনি

মধ্যদুপুরে অশরীরী দেবদূত তর্জনী নাড়ে
স্বাদগন্ধস্পর্শভোগ কাম বিলায় নীড়ে

ঠাকুরদা
মণিপুর রাজ্য এখন বর্মণ দস্যুদের আক্রমণে এত ব্যতিব্যস্ত যে, এই অপয়া ও নিষ্ফলা অঞ্চলের দিকে ততটা মনোযোগ রাখতে পারছে না মণিপুর। এজন্যই এই অঞ্চল মণিপুরি সেনাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কোনো তাড়া নেই।
ধীরে-সুস্থে মণিপুরের দিকে এগিয়ে চললেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য।
চারদিক গভীর অরণ্যে আচ্ছন্ন।
অসংখ্য ফল-অফলের বৃক্ষ, অসাধারণ সব জীববৈচিত্র্য পাখি মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে স্বস্তি এনে দেয়। অরণ্যের মধ্যেই একটি ভগ্ন শিবমন্দির দেখতে পেলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য এখানেই সেনাঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেন।
রাজনির্দেশে এই স্থানটিকে রাজাশ্রমের জন্য উপযুক্ত করে নেওয়া হয়।
রাত্রিটি নিরাপদে কাটাতে পারলেই হয়।

রাত্রির আহারের পর, মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ভাবলেন: যদি এই অঞ্চলে ছোটখাটো একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে এই ভগ্ন শিবমন্দিরটিকে মেরামত করে এখানেই আমার রাজসভা করতে হবে। এই রাজসভার প্রধানমন্ত্রী হবেন রাধারমণ। তাছাড়া অরণ্যে অনেক বুনো মহিষ রয়েছে। সেগুলো ধরে এনে পোষ মানিয়ে নিতে পারে বীরবৃন্দ। এতে দুধ ও মাংসের চাহিদা মেটানো হবে, উত্তমরূপে। তাছাড়া পাহাড়ি নদী ও হ্রদে প্রচুর মৎস্য রয়েছে। অরণ্য কেটে চাষাবাদেরও ব্যবস্থা করা যায়। এখানে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রশান্তির সুবাতাস বইবে আমার জীবনে। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তার সেনাপ্রধানের মুখে যা শুনলেন, তা থেকে তিনি অনুমান করলেন যে, প্রাচীনকাল থেকেই ত্রিপুরার জনগোষ্ঠী মণিপুরের এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে তোলে। উর্বর জমি, জলে প্রচুর মাছ ও স্থলে বন্যপ্রাণীর সহজলভ্যতায় এই অঞ্চলে এখনো বিচ্ছিন্ন কিছু ত্রিপুরার জনপদ রয়েছে।

মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ভাবলেন: তাদের মধ্য থেকে শক্তসামর্থ্য মানুষ নিয়ে ছোটখাটো একটা সেনাদলও গড়ে তোলা যায়। নদী থাকায় জলপথে যোগাযোগব্যবস্থাও খুব সহজে করা যায়। ফলে ব্যাবসা-বাণিজ্যের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি একটা নৌসেনাদল গড়ে তোলা যেতে পারে। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের অন্তরে এই ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপনের সম্ভাবনার বীজ সৃষ্টি হয়। তিনি জানেন, সকলের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমে কয়েক বছরের মধ্যে এই অঞ্চল বিপুল সমৃদ্ধ হবে।

নাতনি
ঠাকুরদা, তুমি মূল কাহিনিতে ফিরে যাও।

ঠাকুরদা
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনার যেমন আজ্ঞা। তাহলে শুনুন…

গোমতীর স্রোত: রাজমালা

নিঃশব্দে দ্বিধাদ্বন্দ্বে চোখ দুটি অতৃপ্ত
পরিত্যক্ত উপত্যকায় পার্থিবমূর্তি ঘনীভূত

কালক্রমে মণিপুর বিস্তৃত হতে হতে ত্রিপুরার সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। মণিপুর রাজবংশ যুদ্ধবিদ্যায় খুবই পারদর্শী, জাতিতে যোদ্ধা। এই রাজবংশের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বাসনা মনে-মনে পোষণ করতেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। তিনি মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দ ও মনোমোহিনীর রাজকীয় বিবাহানুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বাঁধন সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের ভ্রান্ত কৌশলের জন্য মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তাদের বিবাহানুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি, যদিও তাদের বিবাহ হয় বিশাল উৎসবের মধ্য দিয়ে। বিবাহের পর, মণিপুরের বর্তমান রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র সুঠাম, সুকুমার, সর্বগুণের আধার যুবরাজ নিত্যানন্দ রাজ্যরক্ষায় মনোনিবেশ করেছে। বর্শা চালনা, তলোয়ার খেলা, ধনুর্বাণ ছোড়া, ঘোড়ায় চড়ে লাফিয়ে নদী পার হওয়া—এসব সে শিখে নিয়েছে অতি সহজেই। সে মিথ্যা ও নীচতাকে ঘৃণা করে। সে শপথ রক্ষা করে।

মণিপুরি সেনাছাউনি পড়েছে ত্রিপুরার সীমান্তে। এটি স্থাপন করা হয়েছে সুনসান জঙ্গলের মতো এক জায়গায়। অবশ্য আশপাশে কিছু জনবসতি রয়েছে। তবে এখানে জঙ্গলের গাছপালা ও লতাগুল্ম খুব বেশি ঘন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু গাছ-কাটা গুঁড়ি প্রমাণ করে যে, সন্নিকটেই হয়তো মানুষের বসতি রয়েছে। দিনের আলোয় কাঠ কাটতে আসা দু-একজন কাঠুরের সাক্ষাৎ পায় মণিপুরি সেনাদল।

সেনাছাউনিতে অপেক্ষারত মনোমোহিনী আবিষ্কার করল তার পিতা নিকটেই অবস্থানরত। সে তার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠল। মণিপুরের সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে সে মহারাজের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করল। মনোমোহিনী যেন এক অপ্সরী! মণিপুরে আসার পর যেন তার গায়ের রং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন উজ্জ্বল তামার মতো দ্যুতিময়। চোখে-মুখে হরিণীর চাঞ্চল্য। পোশাকে রাজকীয় চাকচিক্য। পায়ে ছন্দ। দেহভঙ্গিতে রমণীয় আন্দোলন, যেন আকাশের সাদা মেঘের সৌন্দর্য ঝরে পড়ছে। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোও যেন তার রূপের কাছে হার মানে। এক সময় সে তার দলবল নিয়ে এসে উপস্থিত হল ভগ্ন শিবমন্দিরে। এখানে সে তার পিতার সাক্ষাৎ পায়। তিনি ভীষণ অসুস্থ। গত রাত্রি থেকে তিনি কোনো কথা বলতে পারছেন না। পিতার অবস্থা দেখে মনোমোহিনী ভীষণ কষ্ট পায়। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে সে তার পিতাকে সুস্থ করতে চায়। তাই সে তার পিতা ও পিতার অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে মণিপুরি সেনাছাউনিতে ফিরে আসে। মনোমোহিনী মনে-মনে বলতে থাকে: আমি আমার সমস্ত কিছু দিয়ে হলেও পিতার অন্তরের যন্ত্রণাকে উপশম করব। প্রয়োজনীয় সেবা ও ভালোবাসা দিয়ে তার সকল দুঃখকষ্টকে ভুলিয়ে দেব।

মণিপুরি সেনাছাউনিতে অবস্থানরত মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কাছে, একদিন এসে উপস্থিত হলো মনোমোহিনী, একটু আনমনেই। সময় কী দ্রুত ফুরিয়ে যায়, হারিয়ে যায়, পুরাতন হয়ে যায় জীবনের কত ঘটনা, কত মুহূর্ত! এই অবিশ্বাস্য সময়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর-কিছুই করার থাকে না।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের পাশে বসা রাধারমণের উদ্দেশ্যে মনোমোহিনী বলল, আপনার মহত্বের তুলনা হয় না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রাধারমণ বললেন, মহারাজের সেবা ও যত্ন করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের দিকে তাকিয়ে মনোমোহিনী বলল, কেমন আছেন পিতা?
নিজের মধ্যে ছিলেন না মহারাজ, তাই সামান্য চমকে উঠে বললেন, মনের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমাকে অন্ধকার থেকে বের করে এনে তুমি ভুল করেছ। দীর্ঘ জীবনের অভিশাপ অসীম। এবার ভালোয় ভালোয় চলে গেলেই হয়।
মৃত্যুর ইঙ্গিতে মনোমোহিনীর ভালো লাগল না। মৃত্যুর কথা শুনলেই তার বুকের মধ্যে গোপনে একটি আঘাতের সৃষ্টি হয়। সে মুখ নত করে বলল: পিতা, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন তো?
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য জোরে মাথা নাড়লেন, তুমি স্বর্গের দেবী। তোমাকে চিনতেই আমার ভীষণ ভুল হয়েছিল। তোমার মতো এমন সন্তান আর কেউ জন্ম দেয়নি। আমার দুঃখের সাথী তুমি।
মনোমোহিনী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার পিতার দিকে। এ-যেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দৃশ্য, তারপর একটু জোরে, তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল: আমার দিকে তাকান পিতা। আমাকে আশীর্বাদ করুন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তাকালেন তার কন্যার দিকে। চোখে-মুখে ঝকঝক করছে বুদ্ধির দীপ্তি। মনোমোহিনীর মুখকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দেখে নিয়ে মহারাজ বললেন, আমার সঙ্গে কোনো কিছু গোপন কোরো না। আমি একজন বৃদ্ধ পিতা।

এক মুহূর্তের জন্য যেন স্তব্ধতা নেমে এলো। মনোমোহিনী কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু চক্ষু দিয়ে কয়েক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে নিয়ে বিষাদ-মেশানো কণ্ঠে বললেন, কেঁদো না। তুমি যদি এখন আমাকে বিষ এনে দাও, তবুও আমি তা পান করব। আমি জানি তুমি আমার মঙ্গল কামনা করো। কিন্তু তোমার দিদিরা যেন কাকের বাসায় কোকিলের ছানা, তারা আমার ওপর অন্যায় করেছে। তুমিও আমাকে ভালো না-বাসলে অন্যায় হবে না।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কথা শুনে মুহূর্তেই থেমে গেল মনোমোহিনীর মনের প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিতের দোলাচল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কাঁদছি না পিতা। এটি আমার আনন্দাশ্রু।
দুঃখে অনুতাপে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, আমার এরকম ভুল আর কখনো হবে না।
রাধারমণ পাশ থেকে বলে উঠলেন: মহারাজ, আপনি কোনো ভুল করেননি। করতেও পারেন না।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মাথার ওপর যেন কালো অন্ধকার ঝুঁকে রয়েছে। একদিন তিনি ছিলেন ভাগ্যান্বেষী মহারাজ; আর আজ রাজ্যচ্যুত এক প্রৌঢ়, প্রায় অবসরপ্রাপ্ত রাজা। তবুও রাজার পক্ষে যেখানে-সেখানে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব নয়। নিরাপদও নয় বটে। তিনি চান ঝঞ্ঝাটপূর্ণ জীবন থেকে পরিত্রাণ। পূর্ণাবসর। তাই হয়তো একটু গলা চেপে রাধারমণের মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন, আমি এখন কোথায় আছি রাধারমণ?
রাধারমণ সমাহিত গলায় বললেন: মহারাজ, আপনি আপনার রাজ্যেই আছেন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য যেন ব্যাখ্যাটি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারলেন না। একটু চুপ করে থেকে বললেন: আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবেন না, রাধারমণ। জানি জানি, আমি বৃদ্ধ আর বোকা মহারাজ।

সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মনোজগৎ ঘিরে সৃষ্টি হয় আরও গভীর অন্ধকার। খুব বিষণ্ণ দেখায় তাকে। রাত্রের অন্ধকারে এই নির্জন জঙ্গলের একটি তাঁবুর নিচে কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটানোর পর রাধারমণের উদ্দেশ্যে বললেন: রাধারমণ, মনে হয় আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ওপারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হয় এখন।
কী যে বলেন মহারাজ! পৌত্র-প্রপৌত্রাদির মুখদর্শন না করে কোনো মহারাজাই স্বর্গে গিয়ে সুখ পান না।
কথাটি হয়তো সত্যি। কিন্তু সবার ভাগ্য তো আর একই রকম হয় না, রাধারমণ।
তা অবশ্য ঠিক, মহারাজ।
রাধারমণ, আপনি কি আমাকে এখনো মহারাজই বলবেন! আমি তো এক রাজ্যচ্যুত রাজা এখন।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন উভয়ই। যেদিন প্রথম এখানে এসেছিলেন, সেই রাত্রিটি ছিল তীব্র জোছনায় ভেসে বেড়ানো মেঘের মতো হালকা, অজানা এক অলৌকিক রহস্যে ঘেরা। ঠিক তার বিপরীত যেন আজ। ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন, সামান্য দূরের কোনো কিছুই দৃষ্টিতে পড়ে না। অথচ সামনে সেনারা রয়েছে। ঝরনা রয়েছে। পাহাড়ি ছড়া রয়েছে। বালুময় স্থল, বনজঙ্গল, বন্যপ্রাণী, নিশাচর পাখির ঝাঁক, প্রকৃতির বিচিত্র আয়োজন—সবই রয়েছে। শুধু নেই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের দৃষ্টির ভেতর এসবের অস্তিত্ব! নীরবতা ভেঙে রাধারমণ বললেন: মহারাজ, প্রার্থনা করি আপনি আবার রাজ্য ফিরে পান। যদি না-ও পান, তাহলেও আমার কাছে আপনি মহারাজ, আমার প্রভু।
ঠিক আছে, রাধারমণ।

দীর্ঘ নীরবতা আবার নেমে আসে তাদের ঘিরে। জঙ্গলের গভীর দিকে একটা আলোড়ন টের পাওয়া যায়। গা ছমছম করে ওঠে দুইজনের। এখানে কাটানো প্রথম রাত্রির কথা মনে পড়ে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের। তিনি সচেতন হয়ে বসেন। দূরের একটা ঝোপ ঘিরে যেন আলোর মেলা বসেছে। নিকষকালো অন্ধকারের ভেতর আলোর এই বৃত্তটাকে মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র অস্তিত্বশীল আয়োজন। বিষাদে ঢাকা এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাধারমণকে জিজ্ঞেস করলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য: আমার মনের একটা ইচ্ছে পূরণ করবেন আপনি, রাধারমণ?
বলুন, মহারাজ।
মনোমোহিনীকে কথাটি বলার ইচ্ছে করেনি। এখানে আসার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে আমার, রাধারমণ। আমার চিতা যেন হয় মণিপুরেই। মনোমোহিনীর দৃষ্টির কাছেই যেন আমার মঠ তৈরি হয়। মৃত্যুর পর আমার দেহাবশেষ যেন মণিপুরের লাল মাটি ও পাহাড়ি জলের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। মণিপুরই যেন হয় মহাবিশ্বে আমার বিলীন হয়ে যাওয়ার পুণ্যভূমি। মানবজীবনের মহাতীর্থ। যাকে বুকের ভেতর গোপনে লালন করে এসেছি এতকাল, সেই যেন হয় আমার স্মৃতি রক্ষার প্রহরী!

ঘনকালো এই অন্ধকার রাত্রে অকস্মাৎ এই ধরনের একটা প্রস্তাব আসতে পারে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কাছ থেকে, তা রাধারমণ কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। অন্ধকারে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না, তাই রাধারমণ সঠিকভাবে বুঝতে পারছেন না তার মনের অবস্থা। কত সচেতনভাবে মৃত্যুর প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন, তা মুখদর্শন করে রাধারমণের বোঝার কোনো উপায় নেই। রাজ্যচ্যুত মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য এখন রাধারমণের চোখে একজন অপরাজেয় মহারাজা। তার যদি এমনই ইচ্ছে তাহলে তা পালন করতেই হবে! রাধারমণ কিছু বলছেন না দেখে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলছেন না যে রাধারমণ?
ঠিক তখনই মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দ এসে জানাল, ত্রিপুরার সেনাদল মণিপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের সেনাদলও প্রস্তুত আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। তারপর মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের দিকে তাকিয়ে যোগ করল: পিতা, আমাদের ক্ষমা করবেন। কোনো রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য নেই মণিপুরের। শুধু আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও সম্মান রক্ষার্থে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হতে হচ্ছে।

চলবে…

এসইউ/এএসএম

Exit mobile version