হাঁটি হাঁটি পায়ে টেস্ট ক্রিকেটে দুই যুগ পূরণ করল বাংলাদেশ। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ক্রিকেটের অভিজাত মঞ্চে অভিষিক্ত হয় লাল–সবুজের দল। সে থেকে এখনও পর্যন্ত ১৪৮ টেস্ট খেলেছে টাইগাররা। এর মধ্যে ১০৮ ম্যাচে হার। আর জয় মোটে ২১ম্যাচ। বাকি ১৯ ম্যাচ ড্র। একটি জয়ের বিপরীতে পাঁচ ম্যাচের চেয়েও বেশি হার। টেস্ট ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর মধ্যে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে এখনও পর্যন্ত হারাতে পারেনি বাংলাদেশ।
দুই যুগের পথ পরিক্রমায় টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সংগ্রামকে তিনটি পর্যায়ে দেখা যেতে পারে। প্রথম পর্যায়ে ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট। এর মধ্যে টাইগাররা খেলে ড্র করার প্রথম কৃতিত্ব দেখায় ২০০৪ সালে। সেন্ট লুসিয়া টেস্টে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে হারতে দেননি খালেদ মাসুদ পাইলট ও মোহম্মদ রফিক।
পরের বছরই টেস্টে আসে প্রথম জয়। চট্টগ্রামে সফরকারি জিম্বাবুয়েকে হারায় টাইগাররা। ঢাকায় পরের টেস্ট জিতে প্রথম সিরিজ জয়ের গৌরবের অধিকারী হয় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বাংলাদেশের। ঘরের মাটিতে বড় দলগুলোর বিপক্ষেও সাফল্য আসতে থাকে নিয়মিতই।
সর্বশেষ দুই বছরে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশ জয়ের কৃতিত্ব দেখানো শুরু করেছে টাইগাররা। প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে তাদেরই মাটিতে। এ বছর স্বাগতিক পাকিস্তানকে টাইগাররা ডুবিয়েছে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায়।
বলা যায়, বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদায় আসীন হয়েছিল সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে। তবে অভিষেক টেস্টে ময়দানী দক্ষতায় খুব একটা নিরাশ করেনি ‘টিম টাইগার্স‘। ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তি ভারতের বিপক্ষে প্রথম তিনদিন সমানতালে লড়াই করেছিল নাইমুর রহমান দুর্জয় ব্রিগেড। ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে ৪০০ রানের সৌধ গড়ে বাংলাদেশ। জবাবে ভারতের ইনিংস থামে ৪২৯ রানে। শেষ দুদিনে অবশ্য পথ হারায় টাইগাররা।
টেস্ট ক্রিকেটের নতুন দল হিসেবে সম্ভাবনার আগমনী বার্তা জানাতে সেদিন সমর্থ হয় বাংলাদেশ। তবে দুই যুগের পথ চলায় সম্ভাবনার এই কুঁড়িটা ভালোভাবে ফুল হয়ে ফোটেনি। ধরাবাহিকতার অভাবটাই হয়ে উঠেছে প্রকট।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দশা যেন যাদব বাবুর সেই তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার মত। ওঠা–নামার চক্রেই বন্দী। তবে এ সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা বিষয় কিন্তু বেশ লক্ষ্যণীয়। এই দুই যুগে ব্যক্তিগত সাফল্যে টেস্ট ক্রিকেটের বড় বড় রেকর্ডগুলোকে নিয়মিতভাবেই বড় ধরনের ঝাঁকি দিয়ে আসছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
অসংখ্য রেকর্ডের মালা গলায় পরেছে আমাদের ক্রিকেটাররা। তবে এই ব্যক্তিগত অর্জনগুলো বেশিরভাগ সময়ই সর্বোচ্চ দলীয় প্রাপ্তির ফসল হিসেবে ঘরে ওঠেনি। সব কথার এক কথা, ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে যতটা আলো ছড়িয়েছেন টাইগাররা, দলের অর্জন ততটা উজ্জ্বল তো নয়ই, বরং অনেকটায় ফিকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট এই আকাশে তো এই পাতালে।
ধরা যাক চলতি বছরের কথাই। পাকিস্তানকে তাদেরই মাটিতে হেয়াইটওয়াশ করল টাইগাররা। এর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিপক্ষে কোন টেস্ট জয়ই ছিল না টাইগারদের। এত বড় কীর্তি গড়ার পর, স্বভাবতই প্রত্যাশা হলো আকাশচুম্বি; কিন্তু বাস্তবে প্রত্যাশার বেলুন ফুটো হতে কোন সময়ই লাগল না। পাকিস্তান সফরের মাত্র মাসখানেকের মধ্যে ভারত সফরে গেল নাজমুল হোসেন শান্ত ব্রিগেড। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে দলটির চিহ্নমাত্রও দেখা গেল না। আত্মসমর্পণ করল অসহায়ভাবে।
ভারত সফরের পরপরই ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ যুদ্ধে নামল বাংলাদেশ। হালে একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে প্রোটিয়া ক্রিকেট। দলটি অপেক্ষাকৃত নতুন। হোম অ্যাডভান্টেজ নিয়ে অনভিজ্ঞ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টাইগাররা ভাল কিছু করবে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত।
কিন্তু ন্যূনতম প্রতিরোধটুকুও গড়তে পারল না শান্ত বাহিনি। কে বলবে মাত্র দু‘মাস আগে এই দলটাই স্বাগতিক পাকিস্তানকে ডুবিয়ে এসেছে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায়।!
আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে অনুসিদ্ধান্ত টানা বেশ কঠিন। একটা দল যখন উন্নতির পথে থাকে, তার একটা স্বাভাবিক ধারা কিন্তু বেশ সুস্পষ্ট। ধরা যাক, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের কথাই।
১৯৮০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট শক্তিগুলোর কাছে এক তরফাভাবে মার খেয়েছে লঙ্কানরা। এরপর নব্বইয়ের দশকে এসে ধাপে ধাপে এগিয়েছে দলটি। উন্নতির ধারায় থেকে ১৯৯৬’র বিশ্বকাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায় লঙ্কানরা। টেস্ট বেবি আফগানরা হয়তো বিশ্বকাপে ভালো করতে পারেনি। তবে দলটির উন্নতির গ্রাফটা যে ক্রম উর্ধ্বমুখী সেটা আর নতুন করে না বললেও চলে।
উন্নতির একটা স্বাভাবিক স্থিতি থাকে, ন্যূনতম একটা মান থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় এসবের কোন বালাই নাই। সব ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দুর্দান্ত সব ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে টাইগাররা। আবার আকাশ থেকে মাটিতে পতন হতে পারে শিক্ষানবীশ একটা দলের মত। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন ব্যাখ্যার বাইরে।
লেখক: ক্রীড়া সাংবাদিক।
এইচআর/আইএইচএস/জেআইএম