Site icon Amra Moulvibazari

ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণ

ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণ


 

সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় বার নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশি রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন নজিরবিহীন সুবিধাজনক অবস্থানে আসতে পারলেন। ফলে এই জয় কেবল মার্কিন রাজনীতিতেই নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেবে।

এসব কারণে ট্রাম্পের পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মেরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি করছে। ফলে আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে- ক্ষমতার পালাবদলে কারণে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হতে পারে এসব নিয়ে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মূলত দেশটির প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি পররাষ্ট্র বিভাগ, পেন্টাগন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিল এবং কংগ্রেসের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। ফলে রাতারাতি বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ওপর এই বিজয়ের কৌশলগত প্রভাব যে থাকবে তা এখনই বলে দেওয়া যায়।

নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ফ্লোরিডার ওয়েন্ট পাম বিচে উচ্ছ্বসিত জনতার সামনে ট্রাম্পের বিজয়ী ভাষণেও সেই নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কোনো যুদ্ধ ছিল না। আইএসকে পরাজিত করা ছাড়া চার বছর ধরে আমাদের কোনো যুদ্ধ হয়নি। ডেমোক্র্যাটরা বলেছিল, আমি নাকি যুদ্ধ শুরু করবো। আমি যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছি না, বরং যুদ্ধ বন্ধ করতে যাচ্ছি।’

ট্রাম্পের এই ঘোষণা এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় ইতোমধ্যেই ইউক্রেনজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা। মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ইউক্রেনের সামরিক বিশেষজ্ঞরাও। ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তার মাধ্যমে ইউক্রেনকে সমর্থন করতে গিয়ে প্রকান্তরে এই যুদ্ধকে প্রলম্বিত করেন বাইডেন। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় সেই জায়গাটায় নিশ্চিতভাবেই ছেদ পড়বে। এ কারণে সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ইউক্রেনের কাছে যে অস্ত্র মজুদ আছে তার মজুদ শেষ হয়ে গেলেই যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে ইউক্রেন হয়তো রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে। কারণ, বিভিন্ন সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেছেন ট্রাম্প। আর এক্ষেত্রে ট্রাম্পের ইউরোপের সমর্থন পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, কারণ তারাও এই প্রলম্বিত যুদ্ধের পক্ষপাতী নয়।

এ সম্পর্কে এবিসি নিউজের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরে আসায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি বড় রদবদল হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ব্যাপক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা যাচ্ছে ইউক্রেনে। এ কারণেই রাশিয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে জেলেনস্কির দেশ। অথচ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যই নয়। এদিকে ন্যাটোর সবচেয়ে বড় আর্থিক জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। আর ট্রাম্প বারবার এই জোট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, জোটের অন্য দেশগুলোর যে পরিমাণ তহবিল সরবরাহ করা উচিত, তারা তা দেয় না। অর্থাৎ ট্রাম্প এবার ক্ষমতায় বসার পরে ন্যাটোয় হয় মার্কিন অর্থায়ন কমবে, না হয় অন্য সদস্যরা তহবিল সরবরাহ বাড়াতে বাধ্য হবে।

ইউক্রেনের পরই ট্রাম্পের নজর থাকতে পারে ফিলিস্তিনে। গত মেয়াদে ফিলিস্তিনের কোনো সুবিধা না হলেও এবার ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ইউক্রেনের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প জোর দাবি করেছেন, তিনি জিতলে গাজায় ইসরায়েল-হামাস এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধ করবেন। এপ্রিল মাসে তিনি ইসরায়লকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তারা যা শুরু করেছে তা শেষ করতে হবে’ এবং ‘এটি দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে’, কারণ গাজা পরিস্থিতির কারণে ইসরায়েল ‘যুদ্ধে জনসংযোগ হারাচ্ছে’। বিশ্লেষকরাও বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য নীতির অন্যতম প্রধান বিষয় হবে গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ শেষ করা। গাজা নিয়ে তিনি হয়তো নেতানিয়াহুকে বুঝাতে সক্ষম হবেন, কারণ নেতানিয়াহুও হিজবুল্লাহ এবং হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অভ্যন্তরীণভাবে সমালোচিত।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করা হয় চীনকে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সুস্পষ্ট চীনবিরোধী অবস্থান ও পদক্ষেপের আলোকে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-চীনের বৈরিতা এবার আরও তীব্রতর হতে পারে। যদিও বাইডেনের মতো তাইওয়ান ইস্যুতে মার্কিন বাহিনীকে ব্যবহার করে চীনকে হুমকি না দেওয়ার কথাই বলেছেন ট্রাম্প। এ কারণে তাইওয়ান ইস্যুতে চীন হয়তো খানিকটা স্বস্তি পাবে। তবে চীনের জন্য দুঃসংবাদ হবে ট্যারিফ। এই ট্যারিফ নিয়ে যুদ্ধ এর আগেও দেখেছে বিশ্ব। নির্বাচনী প্রচারণাতেই চীনের বিরুদ্ধে আবারও বাণিজ্যযুদ্ধের সেই পথে হাঁটার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈরিতাই মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছে। আর সেখানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ফলে বেইজিংয়ের প্রভাব রুখে দিতে নরেন্দ্র মোদির প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্ক ‘হাউডি, মোদি!’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’—এর মতো উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়েছে। এটি চীনের প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের অংশ হিসেবে এই অঞ্চলে ভারতকে আরো প্রভাব খাটাতে ও স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিতে পারে। আর এই সম্পর্ক মোদির সরকারকে আরও শক্তিশালী করবে।

তাছাড়া, কোয়াড জোটকে আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে ভারতের সাথে সম্পর্ককে আরও গভীর করতে পারেন ট্রাম্প। চীন ও রাশিয়ার সাথে যদি সরাসরি সংঘাতে জড়ায় আমেরিকা, তাহলে ভারত কতটা পাশে থাকবে তা নিয়ে সংশয়ের কারণে ভারতকে বাদ দিয়েই চলতি বছর ‘স্কোয়াড’ জোট গড়ে আমেরিকা। কিন্তু বাইডেনের এই নীতিকে বিশেষ পাত্তা দেবেন না ট্রাম্প, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের বিশ্বাস, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের প্রভাব রুখতে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, ২০২৫ সালে ভারতে আয়োজিত কোয়াড জোটের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি ভারতে এলে গোটা বিশ্বের কাছে বার্তা যাবে, চীনকে রুখতে নয়াদিল্লির উপরেই আস্থা রাখছে আমেরিকা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশেরই বিশেষ আগ্রহ থাকে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি আরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবার। ক্ষমতার এই পট পরিবর্তন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল এবং এইক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার ফলে মানবিক সহায়তা খাতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে, যা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের খুব ভালো বৈশ্বিক ইমেজ আছে। ডেমোক্র্যাটদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ড. ইউনূস এখন হোয়াইট হাউজে যে অবাধ স্বাগত ও সমর্থন পান, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে তা নিশ্চিতভাবেই ব্যাহত হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেই ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প। গত ৩১ অক্টোবর, এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমরা আপনাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব। আমার প্রশাসনের সময় আমরা ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারত্ব আরও জোরদার করব।’ নরেন্দ্র মোদীর সাথে সম্পর্ক আর এই ইকুয়েশন থেকে ধারণা করা যেতে পারে বাংলাদেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে পারেন।
কারণ, সুযোগ পেলেই ট্রাম্প বিভিন্ন মাধ্যমে জানান দেন যে, ভারত এবং নরেন্দ্র মোদি তার ভালো বন্ধু। তবে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি যে যে খুব পরিবর্তন হবে তা-ও কিন্তু নয়। এটা অনেক যদি-কিন্তুর উপর নির্ভর করছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হবেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এসব হিসাব-নিকেশ বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বিজয় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনীতির ভারসাম্যকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে পারে। তাই ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প কী ভাবে আগায়, সারা বিশ্বের নজর থাকবে সেদিকেই।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।
Exit mobile version