ব্রিটিশ আমল থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৎস্য আহরণ করলেও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেননি শুঁটকি পল্লীর জেলারা। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে এরইমধ্যে পুঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে চড়াহারে মহাজনদের সুদের মাশুল গুণে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সোমবার (৪ নভেম্বর) থেকে সুন্দরবনে শুরু হচ্ছে এবারের শুঁটকি তৈরির মৌসুম। পাঁচ মাস চলবে মাছ ধরা ও শুঁটকি করার কাজ। এরইমধ্যে নির্ধারিত রাজস্ব দিয়ে সুন্দরবন বিভাগ থেকে পাস পারমিট পাওয়ার পর মোটা অঙ্কের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দুবলাসহ পাঁচটি চরে উপকূলের প্রায় ১০ হাজার জেলে যাত্রা শুরু করেছেন।
চট্টগ্রাম, কয়রা, সাতক্ষীরা, বরগুনার পাথরঘাটা, পিরোজপুর, বাগেরহাটের শরণখোলা, রামপাল ও মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জেলেরা রোববার (৩ নভেম্বর) মধ্যরাতে দুবলার চরে রওনা হচ্ছেন। আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাগর বক্ষের এই ছোট্ট চরে চলবে জেলেদের মহাব্যস্ততা। দুবলার চর, আলোরকোল, মাঝেরকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালারচরে মৌসুমের পাঁচ মাস চলবে শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া।
এ বছর শুঁটকি আহরণ মৌসুমে এই পাঁচটি চরে এক হাজার ১০৮টি জেলে ঘর, ৭৮টি ডিপো ঘর ও শতাধিক দোকানঘর তৈরির অনুমতি দিয়েছে বনবিভাগ। দুবলার চরকেন্দ্রিক গত বছরের শুঁটকি মৌসুমে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এ বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার শুঁটকি উৎপাদন বাড়বে এমন প্রত্যাশা বন বিভাগের।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী নুরুল করিম বলেন, ‘সুন্দরবনের দুবলার চর, আলোরকোল, মাঝেরকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালারচর এই পাঁচটি চরে শুঁটকি আহরণ মৌসুম শুরু হচ্ছে সোমবার। দুবলার পাঁচটি চরে টানা পাঁচ মাস অবস্থান করবেন ১০ হাজারের বেশি জেলে। এ বছর দুবলা শুঁটকি পল্লীতে জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য এক হাজার ১০৮টি ঘর, ৭৮টি ডিপো এবং শতাধিক দোকান স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় সোমবার সুন্দরবনে শুরু হয়েছে শুঁটকি আহরণ মৌসুম। তা চলবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। শুঁটকি আহরণ মৌসুমে জেলেরা অস্থায়ী থাকার ঘর, মাছ শুকানোর চাতাল ও মাঁচা তৈরি করবেন। এ বছর শুঁটকি আহরণ থেকে সাত কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে বলেও আশা করেন তিনি।
এদিকে অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ায় শুঁটকি মৌসুম ঘিরে প্রস্তুতিতে ব্যস্ত উপকূলের জেলেরা। বঙ্গোপসাগরের পাঁচটি চর নিয়ে সুন্দরবনে সবচেয়ে বড় মৎস্য কেন্দ্র দুবলার শুঁটকি পল্লী। মাথায় বড় ঋণের বোঝা নিয়ে তারা এসব চরে শুঁটকি তৈরির কাজ করবেন।
শুঁটকি আহরণে মোংলার চিলা খাল থেকে রওনা হওয়া সাতক্ষীরার জেলে শুভঙ্কর হালদার ও শরজিৎ বিশ্বাস বলেন, ২০ লাখ টাকা ঋণ করে সমুদ্রে যাচ্ছি। কী হবে জানি না। সংসার চলে এই শুঁটকি আহরণ করে। প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না। প্রতি বছর মন্ত্রী-মিনিস্টার ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং সমাধানের জন্য আশ্বাস প্রদান করেন। আজও পর্যন্ত আশ্বাসের কোনো সুফল আমরা পাইনি।
বছরের পাঁচ মাস সাগরের লোনা পানি আর ঝড়- জলচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে মাছ ধরবেন। তারপর তা রোদে শুকিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে শুঁটকি তৈরি করতে হবে। তাদের মতো ৯০ শতাংশ জেলেই বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছেন বলেও জানান তারা।
অপরদিকে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় মৎস্যজীবীদের আয়ের পথে বড় বাধা দূর হলেও আছে সংশয়ও। জেলে রহিম জমাদার, মোখলেসুর রহমান ও সেলিম আকন বলেন, গত চার-পাঁচ বছর দস্যুদের উৎপাত ছিল না। তবে এবার শুনেছি জলদস্যুরা নাকি আবার সাগরে নেমেছে। তবে এখনো দেখিনি। দুবলার চরে গেলে বোঝা যাবে। তবে দস্যুরা সাগরে নামলে তাদের সর্বনাশ হবে। এজন্য কোস্ট গার্ডের নিরাপত্তা চান তারা।
জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপশি অবৈধ জালে কেউ যেন মাছ ধরতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের কর্মকর্তা কমান্ডার রাশেদুল করিম।
এ বিষয়ে সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন আমাদের প্রকৃতিক রক্ষাকবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মায়ের মতো আগলে রেখেছে। কিন্তু আমাদের লোভের বলি হয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এ বন। এ বনকে রক্ষা না করলে আগামীতে এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন হতে পারে। এজন্য বনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম রক্ষায় সরকারি বেসরকারিভাবে সকলকে সমান উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসতে হবে। জেলেরা যাতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে শুঁটকির জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
বন বিভাগের সুত্রে জানা যায়, শুঁটকি মৌসুমে জেলেরা আহরণ করে অন্তত ১৫ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ, চার হাজার টন চিংড়ি ও শিলা কাঁকড়া। রুপালি ইলিশের শিকার প্রায় ৮’শ টন। রাজস্ব আয় তাই ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা বন বিভাগের।
এফএ/জেআইএম