রাজশাহী মহানগরীর সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম স্পট ভদ্রা মোড়। প্রায় প্রতিদিন এখানে ছোট বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ে যাত্রী ওঠানোর জন্য সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে আন্তঃজেলা বাস কাউন্টার। সেই কারণে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। ফলে অন্যান্য পরিবহনের যাতায়াতেও বিশৃঙ্খল যানজট দেখা দেয়। রাস্তার দু’পাশের দোকানিরা ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে কাজ করে। যার জন্য রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে রাস্তাজুড়ে অবৈধভাবে অটোরিকশা, যন্ত্রচালিত রিকশাগুলো যাত্রীর আশায় যত্রতত্র ছুটাছুটি করে। এই অবস্থায় পরচারিদের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হয়। এসব কারণে দুর্ঘটনায় এখানে প্রাণহানিও কম নয়।
গত সোমবারেও যানজটের কারণে সাত বছরের এক নিষ্পাপ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসী অস্থায়ী বাস টার্মিনাল নওদাপাড়ায় স্থানান্তর, পথচারীদের নিরুদ্বিগ্ন চলাচলের জন্য ফুটপাতমুক্ত করা, রাস্তার অর্ধেক জুড়ে বিভিন্ন ধরনের দোকানীদের কাজ করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ অটোরিকশা,যান্ত্রিক রিকশার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ এবং সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থার দাবি জানান। এসময় কয়েকটি গাড়িও ভাংচুর করা হয়। উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে সেনাবাহিনী, সিআরটি এবং পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতিসৌধ “স্মৃতি অম্লান” এই মোড়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গুরত্বপূর্ণ তিনটি রাস্তার সংযোগস্থলের মাঝখানে এই স্মৃতিসৌধ অবস্থিত।এই সৌধের পশ্চিমে স্টেশন রোড।রোডের ডিভাইডারের দুই পার্শ্বে বড় বড় থাই গ্লাসের দোকান। বিশেষ করে বামপাশের দোকানগুলোয় ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে কাজ করে।দিনের বেলায় ব্যস্ততম রাস্তায় ট্রাক ভিড়িয়ে মালামাল নামায়। ফলে গাড়ীঘোড়া চলাচলে এবং পথচারিদের যাতায়াতে মারাত্মক অসুবিধা হয়। এখানেই বাস মেরামত এবং বডি তৈরির একটি ওয়ার্কশপ প্রায় সময় রাস্তা জুড়ে কাজ চালায়। এই স্থানেই সোমবার বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে একটি শিশুর প্রাণহানি ঘটে। স্মৃতিসৌধের উত্তর দিকের রাস্তা রেলক্রসিং পার হয়ে চলে গেছে পদ্মা-চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকাসহ নওদাপাড়ার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের দিকে। আরেকটি শাখা রাস্তা চলে গেছে মেহেরচন্ডি-খড়খড়ি হয়ে বাইপাসে।
স্মৃতিসৌধের উত্তর দিকের বামে দীর্ঘদিন ধরে পুরো ফুটপাতসহ মেইন রাস্তার কিয়দংশ জুড়ে অবৈধভাবে কয়েকটি ফলের দোকানসহ চা স্টল রয়েছে। ডান দিকে একই অবস্থা। পথচারিদের হাঁটতে হয় গাড়ি চলার রাস্তার উপর দিয়ে। এখানেও অবৈধভাবে রাস্তার মধ্যে করেছে অটো স্ট্যান্ড।স্মৃতিসৌধের দক্ষিণ দিকের সড়ক চলে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রুয়েটের দিকে। পশ্চিম-দক্ষিণ কর্ণারে কয়েকটি লোহার সরঞ্জামের নির্মাণ সামগ্রীর দোকান রাস্তার অর্ধেক জুড়ে কেনাবেচার কারবার করে। এখানেই বিভিন্ন জেলা থেকে ফিরে আসা বাসগুলোর স্টপেজ। পুরোটা দিন একের পর এক বাস থামিয়ে যাত্রী নামায়। সেখানেই আবার বাস থেকে নেমে যাওয়া যাত্রীদের তোলার জন্য অটো এবং যান্ত্রিক রিক্সা ভিড় করে। এতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
সকলকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখান দিয়ে চলাচল করতে হয়। ভয়াবহ যানজট হয় স্মৃতিসৌধের পূর্ব এবং পূর্ব-উত্তর কর্ণারে। এখানে আন্তঃজেলা বাসের টিকিট কাউন্টার। বিভিন্ন জেলার বাসগুলো ভদ্রা রেলক্রসিং থেকে সিরিয়ালি ৮/১০টি বাস ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অর্ধেক রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের উঠায়। এসময় অন্যান্য যান এবং মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়। পাশেই নামকরা অতিথি হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। তারা ফুটপাত দখল করে খাবার সামগ্রী প্রস্তুত করে। বিশেষ করে দুপুর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাস্টমারদের বিভিন্ন ধরনের যানবাহন এই ব্যস্ততম রাস্তার অর্ধেক জুড়ে অবস্থান করে চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়।
দীর্ঘদিন ধরে এইসব নানা অব্যবস্থাপনার কারণে ভদ্রার মোড়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। বলতে গেলে, রাজশাহীর ভয়াবহ এবং অসহনীয় যানজটের প্রধান স্পট রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের সম্মুখভাগ।সিরোইলের এই এলাকায় দিবারাত্র প্রচন্ড যানজট লেগেই থাকে। একই রাস্তা হওয়ার কারণে যার ধাক্কা লাগে ভদ্রার মোড়ে। ঢাক-চট্টগ্রামসহ দূরপাল্লার এবং আন্তঃজেলার অস্থায়ী বাস টার্মিনালের অবস্থান সিরোইলে। ব্যস্ততম এই রাস্তার দু’পাশে সবসময় সারি সারি বাস অবস্থানের কারণে ভয়ংকর যানজটের সৃষ্টি হয়। অতি ঝুঁকি নিয়ে সবাই চলাচল করে। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীবাসির তীব্র ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মহানগরীর অভ্যন্তরে ব্যস্ততম সড়কে বাস টার্মিনাল এবং নগরীর মূল পয়েন্ট রেলগেট ও ভদ্রা মোড়ে অবৈধ কাউন্টার ও যাত্রী ওঠানোর টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করায় স্থানীয় প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রাজশাহীকে ক্লিন সিটি, গ্রিন সিটি, এডুকেশন সিটি, হেলদি সিটি বলা হলেও যতদিন অস্থায়ী বাস টার্মিনাল নওদাপাড়ায় তাদের নিজস্ব জায়গায় না যাবে, ততোদিন পর্যন্ত রাজশাহী নগরীর স্থবিরতা ও রুগ্নতা কাটবে না। পরিবহন ব্যবস্থারও অগ্রগতি সাধিত হবে না। যানজট দূর হবে না। সড়ক দুর্ঘটনাও কমবে না। এসব সমস্যা স্থানীয় প্রশাসনের জরুরিভাবে সমাধান করা উচিত বলে নগরবাসী মনে করেন।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) ২০০৪ সালে ৭কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর উপকণ্ঠে নওদাপাড়ায় স্থাপন করে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। ২০১১ সালের জুন মাসে পরিবহণ মালিকদের কাছে টার্মিনালটি হস্তান্তর করে আরডিএ। ২০১৯ সালে,পরে২০২০ সালেও রাসিক কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের সাথে মিটিং করে নওদাপাড়ায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপরেও সেখানে যায়নি। এমনকি ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বরে জেলা প্রশাসন, আরডিএ, আরএমপি,সড়ক পরিবহন গ্রুপ, জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন, জেলা ট্রাক ও কাভার্ড মালিক সমিতির যৌথ সভায় একমত হয়ে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, একই সালের ১ নভেম্বর থেকে সবাই নওদাপাড়ায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে চলে যাবে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আজো তারা সেখানে যায়নি।
পরবর্তীতে বাস চলাচল আরো সহজ ও নিরাপদ করতে ভদ্রা মোড় রেলক্রসিং থেকে পদ্মা আবাসিক-পারিজাত লেক হয়ে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি ব্যয়ে ৪ লেন সড়ক এবং রাতে নিরাপত্তার জন্য আলো ঝলমল করতে রাস্তার দুপাশে আরো কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সুদৃশ্য সড়ক বাতি লাগানো হয় ২০২২ সালে। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেখা গেছে, কারো ক্ষমতা হয়নি রাস্তার পাশে একটা বাস দাঁড় করিয়ে রাখতে। আসলে প্রশাসন নড়বড়ে হলে যা হয়।
জননিরাপত্তা ও শৃংখলা রক্ষায় মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশে পরিবহন চলাচল বিষয়ক অপরাধের কারণে জরিমানাসহ নানা শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু এখানে অবিরত পরিবহন অপরাধ সংঘটিত হলেও দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশদের তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না বলে স্থানীয় দোকানিরা জানান। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশ এখানে দায়িত্ব পালনে চরম গাফিলতি করে। যানজটে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলেও তাদের কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। নগর অন্তঃস্থ পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ট্রাফিক আইনের যথার্থ প্রয়োগ ও কার্যকারিতা। কিন্তু এখানে তা পরিলক্ষিত হয় না। মহানগরী হলেও এখানে নেই কোনো আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা। নগরের পরিবহন ব্যবস্থা সচল রাখতে এবং নগর অভ্যন্তরে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল নিশ্চিত করার জন্য নওদাপাড়ায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের কাছে বাইপাস রাস্তা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেখান দিয়ে বাস চলাচল করেনা। ঐ বাইপাস দিয়ে বাস চলাচল করলে নগরী অনকটা সুশৃঙ্খল হয়ে যাবে।
বছরের পর বছর ধরে ভদ্রায় অস্থায়ী টার্মিনাল থাকলেও নেই কোনো যাত্রীদের উন্নতমানের বিশ্রাম কেন্দ্র, নেই কোনো আবাসিক হোটেল, নেই কোনো ভাল টয়লেট,নেই কোনো মসজিদ, নেই কোনো সৌখিন কেনাকাটার সুব্যবস্থা। রাজশাহী মহানগরীকে নানা বিশেষণে ডাকা হয়। কিন্তু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা বড়ই নাজুক থাকার কারণে সেই সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অস্থায়ীভাবে বাস টার্মিনাল হওয়ার কারণে পরিবহন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। অনিরাপদ অবস্থায় চলছে এ খাত।
একটি সুষ্ঠু ও শক্তিশালী পরিবহন ব্যবস্থা নগরের মুখ্য ও অপরিহার্য উপাদান। পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক না হলে, সেই নগরীকে কখনও সুখকর ও গতিশীল বলা যায় না। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে রাজশাহী মহানগরীকে বলা যায়, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। এখানে আধুনিক ও যুগোপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি।
রাজশাহীকে ক্লিন সিটি, গ্রিন সিটি, এডুকেশন সিটি, হেলদি সিটি বলা হলেও যতদিন অস্থায়ী বাস টার্মিনাল নওদাপাড়ায় তাদের নিজস্ব জায়গায় না যাবে, ততোদিন পর্যন্ত রাজশাহী নগরীর স্থবিরতা ও রুগ্নতা কাটবে না। পরিবহন ব্যবস্থারও অগ্রগতি সাধিত হবে না। যানজট দূর হবে না। সড়ক দুর্ঘটনাও কমবে না। এসব সমস্যা স্থানীয় প্রশাসনের জরুরিভাবে সমাধান করা উচিত বলে নগরবাসী মনে করেন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, সার্ক জার্নালিস্ট ফোরাম রাজশাহী বিভাগ।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম