Site icon Amra Moulvibazari

একদিনে ১০ বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা অপহরণ

একদিনে ১০ বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা অপহরণ


ফের অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। এখানকার গহীন পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের গড়ে তোলা আস্তানা সক্রিয় হয়ে উঠছে। শনিবার (২ নভেম্বর) সকালে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের কানজরপাড়া পাহাড়ি এলাকা হতে বাংলাদেশি সাত কৃষক ও তিন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে অপহরণ চক্রের সদস্যরা। কৃষকদের পরিচয় পাওয়া গেলেও তিন রোহিঙ্গার পরিচয় পাওয়া যায়নি।

চলতি সময় হতে গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা হতে অপহরণের শিকার হয়েছে প্রায় ১৩৪ জন। যাদের বেশিরভাগ ফিরেছেন মুক্তিপণে। শীত শুরুর প্রাক্কালে ফের অপহরণ হওয়ায় আতঙ্কিত সময় পার করছেন পাহাড়ের আশপাশে বসতি ও চাষাবাদ থাকা লোকজন।

অপহৃত কৃষকরা হলেন- টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের করাচিপাড়ার আবুল হোছনের ছেলে আবু বক্কর ও একই গ্রামের নুর আলমের ছেলে মো. আলম, বাঁচা মিয়ার ছেলে গিয়াস উদ্দিন, জলিল আহমেদের ছেলে মো. বেলাল উদ্দিন, নুরুল ইসলামের ছেলে মো. আনোয়ার ইসলাম, নজর আলীর ছেলে নুর হোছন ও আজিজুর রহমানের ছেলে গুরা পুতিয়া।

রোহিঙ্গারা হলেন, উনচিপ্রাং ২২ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে প্রকাশ পেলেও তাদের পরিচয় জানাতে পারেনি সূত্র।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সকাল ৯টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের করাচিপাড়া গ্রামের পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা ‘আবুবকর ঘোনায়’ চাষাবাদের কাজ ও লাকড়ি সংগ্রহকালে সাতজন বাঙালি ও তিনজন রোহিঙ্গাকে ধরে নিয়ে যায়। অজ্ঞাত এ ডাকাত চক্র আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিলেন। ডাকাতদল অপহৃতদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটক রাখে। এ ঘটনায় সন্ধ্যায় মুক্তিপণ দাবি করেছে অপহরণকারীরা।

ভিকটিম বেলালের মা রাশেদা বেগম আহাজারি করে বলেন, আমার ছেলে অন্যদের সঙ্গে পাহাড়ের পাশের ক্ষেতে কাজ করতে গিয়েছিল। অপহরণকারীরা অন্যদের সঙ্গে আমার ছেলেকেও ধরে পাহাড়ে নিয়ে গেছে।

ভিকটিম আনোয়ার ইসলামের ভাই ছৈয়দ কামাল বলেন, সন্ধ্যায় ভিকটিমদের ফোন থেকে কল করে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে। আমরা হতদরিদ্র মানুষ এত টাকা কোথায় পাবো?

সূত্র মতে, গত শুষ্ক মৌসুমে কৃষক, শিক্ষার্থী, টমটম ও সিএনজি চালক এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মিলিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৩৪ জনকে অপহরণ করা হয়। এদের মাঝে ৮০ জন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৪জন রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের শিকারদের মাঝে অন্তত ৬৭ জন মুক্তিপণে ছাড়া পেয়েছেন।

চলতি বছরের মার্চে অপহরণ হয়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণে ফেরা হ্নীলার পানখালী এলাকার মোহাম্মদ নুরের বাবা আব্দুর রহিম বলেন, অপহরণের তিনদিন পর মুক্তিপণে ছেলেকে ফিরে পেয়েছি। হ্নীলা থেকে তুলে নিয়ে শামলাপুরের বাহারছড়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। অপহরণকারীদের দাবি করা পাঁচ লাখ টাকা যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে।

টেকনাফের হ্নীলার পানখালি এলাকার বাসিন্দা নজির আহমদ (৫৮) ছেলে মাহমুদ হোসেনসহ অপহরণের শিকার হয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণে ছাড়া পান বলে উল্লেখ করেন। নজির আহমদ বলেন, অপহরণের সেই দিনগুলো মনে পড়লে এখনো শিওরে উঠি। ওরা (অপহরণকারী) আমাদের গরু বলে পা বেঁধে কাঠের পাটাতন দিয়ে পিটিয়েছে। মুক্তিপণ দিতে দেরি হচ্ছিল বলে তিনবার কেটে ফেলতে চেয়েছিল তারা। ছাড়া পেয়ে আরও এক লাখ টাকা চিকিৎসায় খরচ করতে হয়েছিল।

দরিদ্র নজির আহমদ আরো বলেন, নির্যাতন সহ্য করে মুক্তিপণে ফিরে এসে এখন নিঃস্ব। অভাবের কারণে ভয় নিয়েও জীবিকার তাগিদে পাহাড়ের পাদদেশে ফসলের মাঠে যেতে হয় এখনো।

টেকনাফের পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা বলেন, পাহাড়ে তেমন কোনো অভিযান চালায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপহরণের খবর পেলে দুই এক মাইল হেঁটেই চলে আসেন তারা। এসময় কিছু ছবি ও ভিডিও করা হয়। তারপর মুক্তিপণে অপহৃতরা ফিরে এলে সেইসব ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে সংবাদ করা হয়, দুঃসাহসিক অভিযানে অপহৃতরা উদ্ধার হয়েছে। এসব তথ্য প্রচার পেলে অপরাধীরা আড়াল হয়ে যায়। একে ঢাল হিসেবে নিয়ে পুরোদমে বাড়ানো হয় অপহরণ। যাকে পায়, তাকেই ধরে নিয়ে যায় অপহরণ চক্র।

অথচ শৃঙ্খলাবাহিনী চাইলেই ড্রোন কিংবা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে অভিযান চালাতে পারে। অপহরণের শিকার হচ্ছেন, পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদে যেতে বাধ্য হতদরিদ্র মানুষগুলো। এতে গরীব মানুষগুলো ধারদেনায় মুক্তিপণ দিতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।

হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, বর্ষায় পাহাড়ে যাওয়া দুষ্কর তাই এসময় অপহরণকারীরা ঘাপটি মেরে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের যেখানে-সেখানে বিচরণ করা যায় বিধায়, অপহরণকারীদের অপতৎপরতা বাড়ে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় খুব সহজেই রোহিঙ্গাদের স্থানীয় অপরাধীরা ব্যবহার করতে পারে।

টেকনাফের পাহাড়ের কাছাকাছি বসবাসকারীরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে হোয়াইক্যংয়ের কানজরপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাহমুদ হোছাইন বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে থাকা জমির ফসল পাহারা দিতে হয় হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষায়। কিন্তু ফসল পাহারা দিতে গিয়ে শিকার হতে হয় অপহরণের। সবমিলিয়ে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুস সাকিব খান বলেন, টেকনাফের কানজর পাড়া পাহাড়ি এলাকায় অপহরণের ঘটনা ঘটেছে শুনেই খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ অভিযানে নেমেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের হদিস মিলেনি-তবে, আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

তিনি বলেন, পাহাড়ে আমাদের আভিযানিক দল, আস্তানার কাছাকাছি পৌঁছেছে দেখে ডাকাতরা অনেক অপহৃতদের ছেড়ে দিয়েছিল- ফিরে আসা অনেক ভুক্তভোগীর বক্তব্যে এমনটি উঠে এসেছে। তবে, অপহরণকারীরা যেসব মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করেন সেটি দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যক্তিদের নামে নিবন্ধিত। ফলে পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।

গেলো এক বছর কী পরিমাণ অপহরণের মামলা ও কতজন অপরাধী আটক হয়েছে জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমি আসার পর যাদের উদ্ধার করেছি এ মুহূর্তে তারই তথ্য মনে আছে। বাকী পরিসংখ্যান পরে জানাতে পারবো।

সায়ীদ আলমগীর ও জাহাঙ্গীর আলম/আরএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।
Exit mobile version