Site icon Amra Moulvibazari

ভূমিহীনরাই যে গল্পে ভূমিপুত্র

ভূমিহীনরাই যে গল্পে ভূমিপুত্র


গাজী আবদুর রহিম

ইমদাদুল হক মিলনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ভূমিপুত্র’। এই উপন্যাসের দৃশ্যপটে লেখক গ্রাম্য মহাজন ও ভূমিহীন শোষিত ভূ-শ্রমিকদের জীবনগল্প এঁকেছেন। এখানে বেপারিরা সমস্ত ভূসম্পত্তির মালিক। আর বেলদাররা ভূমিহীন। তাদের টানাপোড়েনের দিন। মানুষের ভূমিতে নামমাত্র শস্যের বিনিময়ে কামলা দেন তারা। গ্রামের প্রাণবন্ত দৃশ্য লেখক বর্ণনা করেছেন নিপুণ হাতে।

আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করাতে উপন্যাসটি গ্রাম্য স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। উপন্যাসটি শুরু হতে দেখে গেছে নৌকার ওপরে। কাদের ও তার ভাগ্নি বাদলার দাওন পেতে মাছে ধরার দৃশ্য দিয়ে। বেলদারদের পেশা বেপারিদের ভূমিতে কামলা দেওয়া। বেলদার বংশের লোক হয়েও কাদেরের এই ভিন্ন পেশায় টিকে থাকার পেছনে আছে জটিল এক গল্প।

একবার সন ওফা চকে দাওন বাইতে চেয়েছিল। তার ওপর চরম ক্ষিপ্ত হন কুদ্দুস বেপারি। বলেন, ‘দাঐন বাইতে চাও চোদানীর পো? যাও, বাওগা। তয় আমগ চকে বাইলে জব কইরা হালামু। খরালিকালে কাম দিমু না। ধান কাটতে দিমু না। দেহুম তহন কি কইরা খাও?’ এই উক্তিই ভূ-শ্রমিকদের শোষণের নিদর্শন দেয়।

বেপারিরা তল্লাটের সব। তারা ভূস্বামী। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কি মানায়? সেজন্য লেখক বলে দিয়েছেন, ‘বেপারিরা তল্লাটের মাথা। বেবাক জমিজিরাতের মালিক।’ কুদ্দুস বেপারি দুশ্চরিত্রের লোক। সে বেপারি বাড়িতে কামলা দিতে যাওয়া নারীদের দেহ ভোগ করে। ক্ষমতার দাপটে তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না।

কাদেরের বোন অতবী বেপারি বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় কুদ্দুস বেপারির কাছে। যার ফসল এই বাদলা। যেই বাদলা মামুর সাথে রাতভর দাওন বায়। আর যার জন্য কাদেরের দাওন বাওয়া বন্ধ করতে পারে না কুদ্দুস বেপারি। ঔপন্যাসিকের মতে, কুদ্দুস বেপারি হলো নষ্টের নারদ!

একদিন কুদ্দুস বেপারি কাদেরকে তার চকে দাওন বাইতে নিষেধ করলে বাদলা বলে, ‘দাঐন বাইলে কি অয়? ধান ক্ষয় অইয়া যায়নি? লও মামু আমরা দাঐন বামুঐ। দেহি হেয় কী করে!’ শোষণের এ কাহিনিতে ছোট্ট বাদলা যেন অনন্য এক প্রতিবাদী চরিত্র।

এ উপন্যাসে অতবীকে প্রধান নারী চরিত্র বলা যাবে কিংবা যাবে না। সে বেপারি বাড়িতে বান্দীর কাজ পায়। এ উপন্যাসের অতবী বউচি, বোচার মাসহ অন্য নারী চরিত্রগুলোকে কঠোর পরিশ্রমী আর ধৈর্যশীল ভূমিকায় দেখা গেছে। এসব নারী চরিত্র গ্রামের সংগ্রামী নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে।

আত্মহত্যার আগে অবশ্য হতভাগী অতবীর বিয়েটা হয়েছিল। বিয়েতে তার মত ছিল না। কারণ তার সাথে যে অন্যায়, নারীত্ব হরণ করা হয়েছে, তা কেবল স্বয়ং সেই-ই জানতো। হজুকে সে ঠকাতে চায়নি। অতবী আসমানের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘আমারে তুমি বিয়া কইরো না হজুভাই। বিয়া বইতে মন চায় না আমার। বেপারি বাড়িত কাম করতে করতে বিয়ার স্বাদ গেছে গা।’ এদিকে হজুও নাছোড়বান্দা। বিয়ের এক মাস পর অতবী হলো সন্তানসম্ভবা। তখন তার ওপর দিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেল। যার কারণে সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আপন করে নিলো।

তবে মৃত্যুর পরও অতবীর সত্তা বেঁচে ছিল বাদলার ভেতর। তারপর বাদলার মৃত্যু আরও করুণ সুরে নাড়া দেয় পাঠক হৃদয়। বাদলার মৃত্যুর পর কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে কাদের। বসবাসের জায়গা ছাড়া বাড়তি জায়গা ছিল না তার। বাদলারে কবর দিতে গেলে বেপারিদের গোরস্থানে দিতে হবে। তাই সে বাদলার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ক্ষোভে কাদের বলে, ‘গাঙ্গের পাইনতে ভাইসা আইছিল বাদলা, গাঙ্গের পাইনঐ ভাইসা গেছে।’

সব অন্যায় বেলদাররা চুপচাপ মেনে নিলেও তাদের পরিশ্রমের মূল্য কমে গেলে তারা বেঁকে বসেন। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাদের অধিকার বঞ্চিত করে বেপারিরা। তারপর বেলদাররা সংগঠিত হয়ে তাদের অধিকার আদায়ে মাঠে গেলে বেপারিদের লোকজন তাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। অন্যরা পালিয়ে বাঁচলেও কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাদেরের বুকে এসে লাগে বল্লম। এক ভূমিপুত্র যেন মায়ের কোলেই লুটিয়ে পড়ে। রক্তে লাল হয় ধানক্ষেত।

আসলে এসব ভূমিহীন মানুষের রক্ত মিশে আছে মহাজনদের ভূমিতে। কারণ তারা সারাজীবন অন্যের ভূমিতে কাজ করেও সুবিধাবঞ্চিত। রোগ শোকে জোটে না পথ্য, ওষুধ। অন্যের ভূমিতে কাজ করতে করতে শেষ হয় তাদের জীবন। ‘ভূমিপুত্র’ উপন্যাস মূলত এসব অসহায়, অবহেলিত ভূ-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের অধিকার আদায়ের কথা বলে।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।
Exit mobile version