ছোট্ট তাসনিম মাহিরা তুবা প্রায় সময়ই মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে এবং অসহায়ভাবে তার মা তাসলিমা বেগম রেণুকে খুঁজতে থাকে। তার মাকে গত বছরের জুলাইয়ে ছেলে ধরা সন্দেহে জনতারা পিঠিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
“আম্মু” সে চিৎকার করে ভেঙ্গে পড়ে! চার বছর বয়সী তুবা কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করে, “আম্মু কোথায় ?”
তার খালা জয়নব বেগম মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত শান্ত করার চেষ্ঠা করেন।
তিনি তুবাকে বলেন “তোমার আম্মু আমেরিকা চলে গেছে এবং খুব শীঘ্রই সে তোমার জন্য সুন্দর পোষাক ও অনেক খেলনা নিয়ে ফিরে আসবে।”
“আম্মু কখন ফিরে আসবে?” তুবা জিজ্ঞাসা করে।
“শীঘ্রই” জয়নব বেগম তুবার কাছে শুধু এই উত্তরটাই দিতে পারেন।
খালার এই প্রতিশ্রুতি অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলে তুবা অধৈর্য হয়ে উঠে। কখনো কখনো সে তার মাকে খারাপ এবং কখনো কখনো বিদেশী আম্মু বলে থাকে।
তাসলিমা বেগম রেণুকে ছেলে ধরা সন্দেহে জনতারা মারধর করে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ছয় মাস কেটে গেছে , কিন্তু তার মেয়ে তুবা এখনও জানে না যে তার মা নেই।
” আমরা জানি না আমরা কতক্ষণ তুবাকে এভাবে শান্তনা দিতে সক্ষম হবো। এটি খুবই হৃদয় বিদারক। ” সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান তুবার খালা জয়নব বেগম।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তুবা এবং তার ১১ বছরের ভাই তাহসিন আল মাহির মহাখালিতে তাদের খালার সাথে বসবাস করছে।
বনানী বিদ্যা নিকেতনের ক্লাস ফাইভের শিক্ষার্থী মাহির বুঝতে পেরেছে সে তার মাকে আর ফিরে পাবে না।
“কখনও কখনও সে অস্বাভাবিকভাবে শান্ত থাকে এবং তাকে অনেক চিন্তিত দেখায়। আমরা বুঝতে পারি যে সে সময়ে মাহির তার মায়ের অনুপস্থিতি অনুভব করে, ” মাহিরের খালাতো ভাই সৈয়দ নাসিরুদ্দিন টিটু বলেন।
তাদের মায়ের মৃত্যুর ২ বছর আগে তাদের বাবা-মা আলাদা হয়ে যান।
তাদের বাবা তাসলিম হোসেন বাড্ডায় ছোট একটি ব্যবসা করেন। মাঝে মাঝে তিনি বাচ্চাদের সাথে দেখা করেন তবে তাদের খালারবাড়িতে নয়। তিনি তাদের জীবনে খুব কমই উপস্থিত।
এই ঘটনার পর তিনি একবার মাহিরকে নিজের কাছে কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, ছেলেটি এখন তার সাথেই থাকবে। কিন্তু তাসলিমার আত্নীয়রা তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
জয়নব এখন তুবাকে তাদের বাসার পাশে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তুবা ১৯ জানুয়ারি থেকে স্কুলে পড়া শুরু করেছে।
গত বছরের ২০ জুলাই তাসলিমা বাড্ডা উত্তর-পূর্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তুবাকে ভর্তি করানোর জন্য ওই স্কুলের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে যান। ওইখানে উপস্থিত জনতা তাকে স্পষ্ঠতই শিশু অপহরণকারী বলে সন্দেহ করেছিল।
ভাইরাল হওয়া মোবাইল ফোনের ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক ৪০ বছর বয়সী মহিলাকে লাথি মেরে, হামলা চালিয়ে পদদলিত করে। ওইখানে উপস্থিত কয়েকশ লোকের জমায়েতের মধ্যে বেশিরভাগ লোকই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য মানুষের মাথার প্রয়োজন এমন একটা গুজব দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর হঠাৎই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এরকম শিশু অপহরণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে জনতারা নির্মমভাবে নিরপরাধ মানুষের উপর হামলা করে।
গত বছরের জুলাইয়ে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনতার হাতে মারধরের ঘটনায় কমপক্ষে আটজন নিহত হয়েছেন এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন।
আইন সংস্থা ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, গতবছর জনতার হাতে মারধরে ৬৫ জন নিহত হয়েছিল – সবচেয়ে বেশি হতাহতে সংখ্যা ২৫ জন চট্টগ্রাম বিভাগে এবং তারপরে ২২ জন ঢাকা বিভাগে।
তাসলিমার মৃত্যুর পর , টিটু বাড্ডা থানায় ৪০০-৫০০ অজ্ঞাত লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
টিটু বলেছেন যে তিনি ইতিমধ্যে আদালতে প্রায়শই হাজির হওয়ার জন্য তার চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছেন। যাতে তার অনুপস্থিতি গ্রেফতারকৃতদের জামিন পেতে সহায়তা করতে না পারে।
তবে পুলিশ এখনও চার্জশিট আদালতে জমা দিতে পারে নি। ২২ জানুয়ারি শেষ সময়সীমা পার হওয়ার পরে , ২০ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নতুন সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছে।
প্রায় দেড় মাস আগে তদন্তের ভার বাড্ডা পুলিশ এর কাছ থেকে গোয়েন্দা শাখার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এর আগে পুলিশ এই হত্যার অভিযোগে ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছিল।
মামলার তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসান ফিরোজ এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন , তারা গণপিঠুনিতে অংশ নেওয়া আরও তিন জনকে শনাক্ত করেছেন। তাদের গ্রেফতারের জনয তারা তাদের সবধরণের তথ্য সংগ্রহের চেষ্ঠা করছেন বলে তিনি জানান।
ডিবি কর্মকর্তা আরো বলেন , যেহেতু এই ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক হৈচৈ সৃষ্টি করেছিল , তাই তারা ত্রুটিবিহীন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আন্তরিকতার সাথে এটি তদন্ত করছেন।
তিনি আরও বলেছেন যে , এই হত্যার পিছনে অন্য কোনো কারণ ছিল কিনা এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি ছিল কিনা তা তারা খতিয়ে দেখছে।
“আমরা আশা করি আমরা খুব শীঘ্রই চার্জশিট জমা দিতে সক্ষম হব” তিনি গণমাধ্যমকে জানান।
গত বছরের ১৮ আগষ্ট তাসলিমার বোন নাজমুন নাহার নাজমা এবং টিটু হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন যাতে ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক কোটি টাকা দেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
রিট চূড়ান্ত শুনানির জন্য মুলতবি রয়েছে বলে জানিয়েছেন টিটু।
তিনি বলেন ” আমরা ন্যায় বিচারের স্বার্থে তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি করছি”।
তথ্যঃ The Daily Star
Connect with us in facebook : Amra Moulvibazari