পদ্মা সেতু: আ. লীগ সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক বিজয়?

0
4

বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর পূর্তি হলো আজ। নানা ঘটনা প্রবাহের পর এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নকে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ানোর পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনায় পড়তে হয় সরকারকে। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় পেতে সরে যেতে হয়েছিল অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে। এমনকি জেলেও যেতে হয়েছিল একজন সচিবকে। কিন্তু এই দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন তরিকায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে সরকার। যেটিকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছেন অনেকে।

বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করার পর বিএনপিসহ নানা রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের বিভিন্ন অংশের সমালোচনায় পড়তে হয় সরকারকে। এমনকি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পদ্মা সেতু করার উদ্যোগ বাস্তবসম্মত কিনা সেটি নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়। সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর পর বড় সমালোচনা এসেছিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তরফ থেকে।

২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় বিএনপি নেত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠতে যাবেন না। অনেক রিস্ক আছে।

এই বক্তব্য নিয়ে তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া এই বক্তব্য দেয়ার কয়েকদিন পর গণভবনে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকে পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে, সেটা নাকি জোড়াতালি দিয়ে! হ্যাঁ, একদিক দিয়ে ঠিক। যেহেতু এক একটা পার্ট তৈরি করে একেকটা বসায়। যার এইটুকু জ্ঞান নেই, একটা জিনিস নির্মাণ করতে হলে কীভাবে কী পদ্ধতিতে করতে হয়, যার মাথায় ওই টুকু ঘিলু নাই। উনার মাথায় যে ঘিলু আছে সেটা কিসের? চুরি করা, টাকা বানানো, এতিমের টাকা খাওয়া, মানুষ পোড়ানো, মানুষ মারা’

বিএনপির পক্ষ থেকে আবার জবাব দেয়া হয় একই বছরের ১১ জানুয়ারি। বিষয়টি নিয়ে সংসাদ সম্মেলন করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি খালেদা জিয়ার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, একটা ভ্রান্ত ও ভুল ডিজাইনের উপরে পদ্মাসেতু নির্মিত হলে সেটা যে টিকবে না, সেটা তো উনি (খালেদা জিয়া) ভুল বলেননি। বরং তিনি সাচ্চা দেশপ্রেমিকের কাজ করেছেন। তোমরা এখনও এলার্ট হও, চেঞ্জ দ্য ডিজাইন এবং সেটা সঠিকভাবে নির্মাণ হতে হবে।

সেতুর কারিগরি ত্রুটি আছে দাবি করে ফখরুল বলেন, এটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, পদ্মা সেতু একটা রং ডিজাইনের উপরে নির্মিত হচ্ছে। এটা আমাদের কথা নয়, এটা বিশেষজ্ঞদের কথা। তারা বলছেন, ড্রিল মেশিন যে পর্যন্ত যায়, তার অনেক নিচে দেওয়া দরকার ছিল। এখন যে নকশা করা হয়েছে যার ভিত্তিতে দুইটা পিলার নির্মাণ করতে পেরেছে- এটা ঠিকই আছে। বাকীগুলো টিকছে না। কারণ স্লাইডিং মাড নিয়ে চলে যাচ্ছে। ফলে ওখানে পিলার দাঁড় করানো সম্ভব হচ্ছে না। এটা আপনার ইঞ্জিনিয়ারদের কথা।

এর আগে, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ানোর পর সে সময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন কোনো দেশপ্রেমিক নন, তিনি একজন নির্লজ্জ ব্যক্তি বলে মন্তব্য করেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আর, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আবুল হোসেনের পদত্যাগ এটাই প্রমাণ করে যে দুর্নীতির সকল অভিযোগ সত্য। অপরদিকে, যোগাযোগমন্ত্রীর আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নাগরিক ঐক্যর আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, দুর্নীতি যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের উন্নয়নের ধারাকে নষ্ট করছে, এই ঘটনা তারই আরেকটি উদাহরণ।

বিকল্প উৎস হতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে সরকারের সিদ্ধান্ত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দৃষ্টি সরানোর উপায় বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছিলেন, পদ্মা সেতু দেশি অর্থায়নে হবে না, সম্ভব নয়।

পদ্মা সেতু নিয়ে সমালোচনার জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পন্ন করে এ সকল সমালোচনারই জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ২২ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের পরে দেশের রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের করা সকল সমালোচনার জবাব দেন তিনি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উপমহাদেশের রাজনীতির মাঠে কথার লড়াই নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরহামেশায় এমন কথার লড়াই চলে। তবে শেষ পর্যন্ত জনসাধারণের উপকারে আসে এমন কাজ হচ্ছে কিনা সেটিই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। সেদিক থেকে নানা প্রতিকূলতা ও সমালোচনা মোকাবেলা করে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সরকার একটি বড় রাজনৈতিক বিজয় পেয়েছে।

এমন ধারণার সাথে মিলে যায় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মন্তব্যও। সবশেষ দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পদ্মা সেতুর প্রথম বর্ষপূর্তিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এক পদ্মা সেতুর অর্জন বিরোধীদের ১৪ বছরের আন্দোলন ঢেকে দিয়েছে।

পদ্মা সেতুর অর্জন আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে যেমন স্বস্তি দিয়েছে ঠিক তেমনি আরেকটি স্বস্তিদায়ক বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) লোন পাওয়ার বিষয়টি। ২০২২ সালের শেষ দিকেই সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণের আবেদন করে। এরপরই এ ঋণ নিয়ে শুরু হয় নানা অপপ্রচার ও নেতিবাচক প্রচারণা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ‘মামার বাড়ি নয়’ বলে মন্তব্য করে গণঅধিকার পরিষদ নেতা ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, চাইলেই সরকার ঋণ পাবে এমন নয়। সরকার সেখান থেকে ঋণ পাবে না।

তবে মাত্র ৪ মাসেরও কম সময়ে ৩০ জানুয়ারি ঋণ বরাদ্দ পায় বাংলাদেশ। সে সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উদ্দেশে বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার আশ্বাসে ডুগডুগি বাজাচ্ছেন; এ ঋণ পরিশোধ করবেন কীভাবে? এ ঋণ তো জনগণের কাঁধে বোঝা হয়ে থাকবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, দায়িত্বে থাকলে নানা ধরনের সমালোচনা ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই কাজ করতে হয়। দিন শেষে অর্জনটাই মানুষ বড় করে দেখে। সেদিক থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো অর্জনগুলো আওয়ামী সরকারের বড় সাফল্য হিসেবেই থেকে যাবে।