আসাদের পতনে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

0
1


বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় রচিত হলো। সিরিয়ায় দীর্ঘ ৫৪ বছরের আসাদ পরিবারের শাসনের সমাপ্তি শুধু দেশটির জন্য নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্য এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

গৃহযুদ্ধের এক যুগের বেশি সময় ধরে সিরিয়া ছিল বিশ্ব শক্তি এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থল। বাশার আল-আসাদ প্রথমে উদার সংস্কারক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও শাসনের প্রতি বছর তিনি ক্রমাগত অধিক দমনমূলক হয়ে ওঠেন। আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় প্রবেশ করলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমনের মাধ্যমে আসাদ সরকার দেশটিকে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।

আসাদের শাসন টিকে থাকার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল ইরান, রাশিয়া এবং হিজবুল্লাহর মতো মিত্ররা। বিশেষ করে ইরান সিরিয়াকে তার আঞ্চলিক প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তবে বিদ্রোহীদের আকস্মিক সামরিক সাফল্য এবং আন্তর্জাতিক জোটের পরোক্ষ সমর্থন এই ভারসাম্য পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে।

ইরান এবং এর প্রক্সিদের প্রকল্প এখন বড় সংকটের মুখে। সিরিয়া ছিল ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডর, যা লেবাননে হিজবুল্লাহকে সরাসরি সাহায্য করতে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার হতো। আসাদের পতন ইরানের এই ভূ-রাজনৈতিক হিসাবকে সম্পূর্ণরূপে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আল-নুসরা ফ্রন্ট এবং হায়াত তাহরির আল-শামের মতো শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর কৌশলগত সাফল্য শুধু আসাদ সরকারকে দুর্বল করেনি, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি শূন্যতার জন্ম দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েল এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাফল্যে একটি নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে।

সিরিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা, বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেওয়া এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। একনায়কতন্ত্র যত বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তত বেশি আশঙ্কা থাকে জনগণের ওপর চাপ, আন্তর্জাতিক স্বার্থ এবং চরমপন্থী শক্তির সম্মিলিত চাপ দেশকে সংকটে ফেলে দেবে। বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে এখনই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যেই সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি মোকাবিলার নামে একাধিক হামলা চালিয়েছে। বিদ্রোহীদের এই সাফল্য ইসরায়েলের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে তারা ইরানের প্রভাবকে আরও সীমাবদ্ধ করতে পারে।

তুরস্কের ভূমিকা এই ঘটনায় আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে। বিদ্রোহীদের প্রতি তুরস্কের আগ্রহ এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডে তার সামরিক কার্যক্রম এই ইঙ্গিত দেয় যে আঙ্কারা এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থ রক্ষায় আরও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।
অন্যদিকে, রাশিয়া, আসাদ সরকারের দীর্ঘদিনের মিত্র, এই নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে বেকায়দায় খুঁজে পেয়েছে। সিরিয়ায় রুশ সেনা উপস্থিতি এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার কৌশল এখন নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
আসাদের পতনের ফলে সিরিয়ায় ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কুর্দি অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা দেশটির স্থিতিশীলতাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

এই প্রেক্ষাপটে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব এবং রাশিয়ার কৌশলগত অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল এবং তুরস্কের ভূমিকা কীভাবে এই সংকটকে প্রভাবিত করবে, তা দেখার বিষয়।

বাশার আল-আসাদের পতন সিরিয়ার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু দেশটির নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে গভীর পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এই পরিবর্তন কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং সিরিয়ার জনগণের জন্য তা কী অর্থ বয়ে আনবে, তা নির্ভর করছে নতুন নেতৃত্বের উপর। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান, ইরানের প্রক্সি যুদ্ধের দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা- সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীল।

দুই.
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সিরিয়ার মিল-অমিল নিয়ে কেউ কেউ আলোচনা করছেন। সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে, তবে দুই দেশের প্রেক্ষাপট পুরোপুরি অভিন্ন নয়। সিরিয়া দীর্ঘদিন বাথ পার্টির নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্রের শাসন দেখেছে। হাফেজ আল আসাদ এবং পরে তার পুত্র বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করেছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছেন এবং দেশের জনগণকে চাপের মুখে রেখেছেন। এর ফলাফল হিসেবে সিরিয়ায় গণ-অসন্তোষ সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে, যা পরে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর (যেমন, আইএস এবং এইচটিএস) উত্থানের পথ সুগম করেছে।

বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে বোঝা যায় যে, দীর্ঘমেয়াদী একদলীয় শাসন এবং বিরোধীদের দমন একইভাবে অসন্তোষ জন্ম দিতে পারে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সামাজিক কাঠামো এমন যে তা সরাসরি সিরিয়ার ধাঁচে পতনের দিকে যাবে না। বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহাসিকভাবে গণ-আন্দোলনে সক্রিয় এবং সামরিক সংঘাতের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি আগ্রহী। তবে দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক কাঠামো যদি সংকুচিত হয়, তাহলে তা মৌলবাদী শক্তির উত্থানের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।

সিরিয়ার বাথ পার্টির শাসন এবং বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থার মধ্যে মিল হলো, উভয় ক্ষেত্রেই বিরোধী কণ্ঠকে দমন করা হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন দল বা গোষ্ঠী নিজেদের অবস্থানকে দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী করার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের শাসন পদ্ধতিতে জনগণের মধ্যে হতাশা জন্ম নেয় এবং ভিন্নমতাবলম্বীরা চরমপন্থার দিকে ধাবিত হয়। সিরিয়ার ক্ষেত্রে আইএসের মতো চরমপন্থী সংগঠন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনগুলো একইভাবে সুবিধা নিতে পারে যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক জায়গা সংকুচিত হয়।

তবে বাংলাদেশের ভিন্নতা হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সুশীল সমাজের সক্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক সংযোগ এখনো দেশকে একটি স্থিতিশীল কাঠামোয় ধরে রেখেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখতে হলে, দেশের ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু চর্চা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, আন্তর্জাতিক শক্তি কিংবা আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকটে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

একনায়কতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়িত্বের অন্যতম অনিবার্য পরিণতি হলো আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডারদের হস্তক্ষেপ। সিরিয়ার ক্ষেত্রে যেমন রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, এবং ইসরাইল নিজেদের স্বার্থে দেশটিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশেও ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এ ধরনের হস্তক্ষেপ হতে পারে। বে অব বেঙ্গলের উপকূলে বাংলাদেশ একটি কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। তাই চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন শক্তি এখানে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে আগ্রহী। যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়, তবে এই শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়ে উঠবে।

সিরিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা, বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেওয়া এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। একনায়কতন্ত্র যত বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তত বেশি আশঙ্কা থাকে জনগণের ওপর চাপ, আন্তর্জাতিক স্বার্থ এবং চরমপন্থী শক্তির সম্মিলিত চাপ দেশকে সংকটে ফেলে দেবে। বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে এখনই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

০৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।