আবারও সংবাদ শিরোনামে কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ।এবার দানবাক্সে জমা পড়েছে ২৯ বস্তা টাকা, স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা। মাত্র কয়েক মাস আগেও সংবাদ হয়েছিলো পাগলা মসজিদের দানবাক্সের টাকা। তখন পাওয়া গিয়েছিল ৭ কোটি টাকার বেশি। এবার ২৯ বস্তায় মিলেছে প্রায় সোয়া ৮ কোটি টাকা।
রীতিমতো উৎসবের আমেজ। জেলাপ্রশাসন, পুলিশ, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও স্থানীয় নাগরিকদের উপস্থিতিতে দানবাক্স খোলা, টাকা গোনা এবং নিরাপদে সেগুলো ব্যাংকে জমা। রীতিমতো হৈ হৈ ব্যাপার। বাংলাদেশে আর কোথাও কোনো মসজিদকে কেন্দ্র করে এমন আয়োজন হয় না। দানবাক্সেও এত টাকা জমা হয় না। শুধু মসজিদ কেন দানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র মাজারগুলোতেও এত পরিমাণ অর্থ জমা হয় না। কিংবা এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতাও চোখে পড়ে না।
অধিকাংশের বিশ্বাস এখানে দান করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। বিষয়টি কি আদৌ সত্য? এটি কি শিরক পর্যায়ে পড়ে না? বছর দুই আগে এই কিশোরগঞ্জ পাগলা মসজিদে মানত কিংবা দান বিষয়ে ইসলামি বিধান কি বলে, জানতে পেরেছিলাম মুফতী ফয়জুল্লাহ আমানের কাছে। কোরিয়ার একটি মসজিদের বর্তমান খতিব মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান বলেছিলেন, দান আর মানতের পার্থক্য বুঝতে হবে। কেউ যদি মসজিদে সওয়াবের আশায় দান করেন, সেই দানে ইসলামি বিধানে কোনো মানা নেই। এবং সেক্ষেত্রে সওয়াব হবে। তবে প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচ্য।
আল্লাহর ঘর মসজিদ ইবাদতের স্থান। এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ইবাদত হবে, দুনিয়ার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়াটা আদৌ যৌক্তিক কিনা বিষয়টি আলেমগণকে চিন্তা করা উচিৎ বলে মনে করি। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশনা দেওয়াটাও প্রয়োজন মনে করি।
মসজিদ পরিচালনার জন্য দান এবং ইচ্ছাপূরণের আশায় দান- দুটি বিষয় ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আবার মসজিদ পরিচালনা ব্যয়টি সত্যই প্রয়োজনীয় কিনা সেদিকটি চিন্তা করতে হবে। যদি মসজিদ পরিচালনার জন্য অর্থ প্রয়োজন না হয় তাহলে, সেটি অবশ্যই অপচয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। অপচয় বিষয়ে ইসলামের বিধান সম্পর্কে আলেমদের কাছ থেকে আমরা নিয়মিত শুনতে পাই। আবার স্থানগত একটা বিষয়ও আছে। মসজিদ সবই মসজিদ। নির্দিষ্ট মসজিদে অপ্রয়োজনীয় হওয়ার পরও সেখানে দান করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে। দুনিয়ার যে কোনো মসজিদেই যেখানে দান করা যায় এবং একই সওয়াব পাওয়া যায়, সেখানে নির্দিষ্ট একটি মসজিদকে বেছে নেয়াটা কি ঠিক?
মসজিদ পরিচালনা ব্যয়ে দান করা বৈধ। তবে শর্ত থাকে যে, এর পেছনে ইচ্ছা পূরণের শর্ত থাকলে সেটা কি বৈধ হতে পারে? যেমন এই মসজিদে দান করলে আমি বিপদমুক্ত হবো কিংবা কোনো উদ্দেশ্য হাসিল হবে। কিংবা আমি বিপদমুক্ত হবো, আমার প্রেমের ইচ্ছা পূরণ হবে ইত্যাদি। অথচ ইসলাম যে কোনো অবস্থায়ই মানত করাকে নিরুৎসাহিত করেছে। এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মান্নত করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন যে, মান্নত কোনো কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে না। মান্নত দ্বারা কেবল কৃপণদের থেকে কিছু সম্পদ বের করে নিয়ে আসা হয়।(বুখারি ৬৬০৮)
তাহলে পাগলা মসজিদে এত টাকা কারা দিচ্ছে? কোন উদ্দেশে দিচ্ছে তা ভাবা দরকার। বলা যায়, এটি কুসংস্কার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কুসংস্কারের জন্ম সঠিক শিক্ষার অভাব থেকে, ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে। শিক্ষার অভাবহেতু মানুষ মনে করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মানত করলে আল্লাহ সেই আশা পূরণ করেন। এবং সেই বিশ্বাসটা একসময় এত গভীর হয়ে যায় যে, মানুষ মনে করতে থাকে এই মসজিদ কিংবা মাজারই যেন আশা পূরণের ক্ষেত্র। যা কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ মুসলমানকে বিশ্বাস করতে হয় একমাত্র আল্লাহই মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের মালিক। কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি নয়।
পরের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে-প্রাপ্ত টাকা খরচের বিষয়টি। মসজিদের পরিচালনা ব্যয় অবশ্যই অগ্রাধিকার পায়। তবে সেই পরিমাণ সামান্যই হওয়ার কথা। মসজিদ কমিটির সভাপতি কিশোরগঞ্জ জেলার প্রশাসক। জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ হয়েছে, এই টাকার মসজিদের বড়সড় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। ছয়তলা বিশিষ্ট ইসলামি কমপ্লেক্সও যার অন্তর্ভুক্ত। পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। এখান থেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যয় বাবদ দানেরও ব্যবস্থা আছে। শোনা যায়, এখানে প্রাপ্ত টাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগটি সফল হলে কল্যাণকর হবে বেশি। কিশোরগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। এতে করে জনচাহিদা পূরণ হবে। অন্তত সেখানে ইসলাম ধর্ম নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ইসলামের প্রায়োগিক দিকগুলো নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী প্রতিটি উদ্যোগই ইতিবাচক এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এই সংস্কৃতি নিয়ে। এখানে যারা দান করছেন তাদের মধ্যে অবৈধ উপার্জনকারীও যে নেই তার নিশ্চয়তা নেই। এই কাজটি যেহেতু বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে পরিচালিত তাই তাকে উৎসাহ দিয়ে অবাস্তবতাকে কি বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না? ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষায় দান করার যৌক্তিকতা নেই এটা শিক্ষিত সবাই বুঝেন। তারপরও যারা বুঝেন তাদের কি উচিত নয় বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার?
আল্লাহর ঘর মসজিদ ইবাদতের স্থান। এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ইবাদত হবে, দুনিয়ার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়াটা আদৌ যৌক্তিক কিনা বিষয়টি আলেমগণকে চিন্তা করা উচিৎ বলে মনে করি। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশনা দেওয়াটাও প্রয়োজন মনে করি।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এএসএম