টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক। চলতি বছরের ১৪ জুলাই কার্যক্রম শুরু করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে প্রায় তিন কোটি ১৬ লাখ ইউনিট (কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা) বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি সোলার প্যানেলের নিচের জমিতে চলছে চাষাবাদ ও পশু পালন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সায়দাবাদ এলাকায় যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে সয়দাবাদ এলাকায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) ২১৪ একর অনাবাদি জমিতে বাংলাদেশের নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) যৌথ মালিকানায় প্রকল্পটি গড়ে উঠেছে।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎখাতের বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশ পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মহাপরিকল্পনা (আইপিইএমপি) অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ ক্লিন এনার্জিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে দেশে মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ।
প্রকল্পের সব সরঞ্জাম চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা ছয় থেকে নয় মিটার উচ্চতার ২৭ হাজার পিলারে বসানো হচ্ছে দেড় লাখেরও বেশি সোলার প্যানেল। প্রতিটি প্যানেলের উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪৫ ওয়াট।- সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্কের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মোহাইমেনুল ইসলাম
গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, দেশের নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ, যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য শিগগির ৪০টি প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে দেশের মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ উৎপাদনের কথা ছিল, যা অর্জিত হয়নি। বর্তমানে দেশের ১১টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৫৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক
সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্কের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মোহাইমেনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের সঙ্গে সমান অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিসিআরইসিএল গঠন করে সরকার। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক বিসিআরইসিএলের প্রথম বিদ্যুৎ প্রকল্প।’
তিনি জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হয়েছে ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় এক হাজার ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা (১১৯ টাকা ধরে)। প্রকল্প বাস্তবায়নে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) থেকে ১৫ বছরে পরিশোধযোগ্য ৫৫ মিলিয়ন এবং ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ১১ বছরের জন্য ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে।
‘প্রকল্পের সব সরঞ্জাম চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা ছয় থেকে নয় মিটার উচ্চতার ২৭ হাজার পিলারে বসানো হচ্ছে দেড় লাখেরও বেশি সোলার প্যানেল। প্রতিটি প্যানেলের উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪৫ ওয়াট।’ বলেন এই তত্ত্বাবধায়ক।
২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় চলতি বছরের জুনে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অপারেশনে যায় গত ১৪ জুলাই। প্রকল্প এলাকা থেকে ১০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার দূরে ডাবল সার্কিট ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করা হয়েছে প্রকল্পের আওতায়। ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্কের লাইফটাইম ধরা হয়েছে ২০ বছর।
২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিই) এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ইমপ্লিমেন্টেশন এগ্রিমেন্ট (আইএ) সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ইউনিটের দাম ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ২০ সেন্ট, টাকার অঙ্কে ১১ দশমিক ২২ টাকা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমে একটি কম্পিউটারের সাহায্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোথাও কোনো প্যানেলে সমস্যা হচ্ছে কি না, উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না, ইনভার্টার ঠিকমতো কাজ করছে কি না ইত্যাদি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ সিফাত জাগো নিউজকে বলেন, সোলার প্যানেলগুলো চীনা কোম্পানি ত্রিনা সোলার থেকে আমদানি করা। লাইফটাইম ২৫ বছর। আমাদের এখানে একদিনে সর্বোচ্চ ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদন আরও বেশি হতো। এবারের বর্ষা একটু দীর্ঘ ছিল। যেহেতু এটি সম্পূর্ণ সূর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল, ফলে সূর্যের আলোর তারতম্যের কারণে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। প্রতি ১৫ দিন থেকে একমাস অন্তর আমরা পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্যানেলগুলোর উপরিভাগ পরিষ্কার করি, যাতে ময়লা না জমে। ময়লার আস্তরণের কারণে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।’
একসময় ধারণা করা হতো, সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে জমি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন জমির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কম লাগে। একই সঙ্গে জমির বহুমুখী ব্যবহারও করা যায়।
প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আহমেদ সিফাত বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ ২০ বছর। যেহেতু সোলার প্যানেলগুলোর লাইফটাইম ২৫ বছর, তাই আমরা পাঁচ বছর বর্ধিত করার আবেদন করবো।’
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় বর্জ্যগুলো চীনে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করেছি।’
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিকাজ
মো. মোহাইমেনুল ইসলাম বলেন, একসময় ধারণা করা হতো, সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে জমি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন জমির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কম লাগে। একই সঙ্গে জমির বহুমুখী ব্যবহারও করা যায়।
তিনি বলেন, সোলার প্যানেলের নিচের জমি এখন সম্পূর্ণ কৃষিবান্ধব। করা যাবে মৌসুমি ফসলের আবাদ। সোলার প্যানেলগুলো উঁচু করে দুই সারির মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা রেখে এমনভাবে বসানো হয়েছে, যাতে ভেতর দিয়ে নৌকা চলাচল করতে পারে এবং নিচে সূর্যের আলো পৌঁছায়। ফলে বর্ষা মৌসুমে মাছ ও হাঁস এবং শীতকালে সবজিজাতীয় ফসল সহজেই চাষ করা যাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মাছ চাষ ও কৃষিকাজে বহুমুখী সুবিধা মিলবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আসন্ন শীত কেন্দ্র করে সোলার প্যানেলের নিচে টমেটো, কুমড়া, কচু, শাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করা হচ্ছে। পাশাপাশি লালন-পালন করা হচ্ছে ছাগল, ভেড়াসহ গবাদি পশু।
সৌরবিদ্যুতের জন্য সব সময় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আবাদি জমি। সেই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে দেশের নতুন সব সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি হাঁস, মাছ চাষ কিংবা শাক-সবজি ফলানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এটিসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে এভাবে চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
এসআরএস/এএসএ/এএসএম