শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতার দ্বন্দ্বে উইলস লিটল ফ্লাওয়ারে ‘অচলাবস্থা’

0
0


রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর এ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন চরমে। এ টানাপোড়েনের মূলকারণ ‘জ্যেষ্ঠতা’। দ্বন্দ্ব এমন রূপ নিয়েছে যে, শিক্ষকরা পৃথক পৃথক দৈনন্দিন হাজিরা খাতায় সই করছেন। একই সঙ্গে রয়েছে অবৈধভাবে নিয়োগ, পদোন্নতির অভিযোগও। তদন্তে সেই অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। চাকরি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন কিছু শিক্ষক। শাস্তি এড়াতে তারা এখন রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছেন। নানামুখী এমন সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রমে।

শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, ২৫ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করা শিক্ষকদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগে শিক্ষক হওয়া ১২ জন শিক্ষক এ সংকট তৈরি করেছেন। তারা বিগত আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের প্রভাবে নিয়োগ পেয়ে উশৃঙ্খল হয়ে ওঠেন। নিয়ম না মেনে জ্যেষ্ঠতার তালিকাও পাল্টে ফেলেন। তা থেকে এ অচলাবস্থার সৃষ্টি।

অচলাবস্থা কাটাতে সবশেষ একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই কমিটি গত ২৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, নিয়ম-বহির্ভূতভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। কমিটির সদস্যরা গভর্নিং বডির পরবর্তী সভায় এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার সুপারিশ করেছেন।

শিক্ষক নিয়োগে যত অনিয়ম
২০১৩ সালের ১৯ মে প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখা (দিবা) প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একই বছরের ২৫ মে লিখিত পরীক্ষা এবং ২৬ জুন প্রার্থীদের ডেমো ক্লাস নেওয়া হয়। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অথচ মৌখিক পরীক্ষার একদিন আগেই ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ১৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ অনুমোদনের রেজুলেশনে সই করা হয়েছে। এতে অনিয়মের চিত্র স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকে প্যাটার্ন (বিষয়ভিত্তিক) বহির্ভূত।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিবন্ধন থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ নিয়োগের সময় অধিকাংশ প্রার্থীর নিবন্ধন সনদ ছিল না। নিয়োগপ্রাপ্তদের ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর যোগদানের কথা থাকলেও অদৃশ্য কারণে তার আগেই যোগদান করেন। কারও কারও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়েছে তার আগেই।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তথ্যানুযায়ী বাংলা বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত নাসরিন আফরোজ, ইংরেজি বিষয়ে তুহিন বিশ্বাস, গণিতে মো. রাসেল, মো. হারুন-অর-রশিদ খান, মোশারফ হোসেন, পদার্থে এ কে এম মাসুদ রানা প্যাটার্ন (বিষয়ভিত্তিক) বহির্ভূত।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গঠিত কমিটিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একজন প্রতিনিধি রাখা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ শিক্ষকও রাখতে হয়। অথচ উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১৪ শিক্ষক নিয়োগের টেবুলেশন শিটে ডিজির প্রতিনিধির সই নেই। প্রায় সবার নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত ছিল না কোনো বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ শিক্ষকও। নিয়োগপ্রাপ্তরা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম (খণ্ডকালীন) হিসেবে কর্মরত থাকলেও প্রভাষক পদে নিয়মিত হিসেবে যোগদানের ক্ষেত্রে আগের পদ থেকে পদত্যাগও করেননি, যা বিধিবহির্ভূত।

হঠাৎ কমিটি করে নতুন তালিকা, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন
২০১৩ সালের নভেম্বরে উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ৭৬তম সভায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। ৮ বছর সেই তালিকা অনুযায়ী চলছিল। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি সেই তালিকায় হঠাৎ পরিবর্তন আনা হয়। এক্ষেত্রে তৎকালীন অধ্যক্ষের আদেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি নতুন তালিকা করে জমা দেয়।

নতুন সেই তালিকা গভর্নিং বডির রেজুলেশনে অনুমোদন না করে শুধু প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে কার্যকর করা হয়। এক্ষেত্রে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮-এর ধারা ১৩ অনুসরণ করা হয়নি। নিয়ম-বহির্ভূতভাবে জ্যেষ্ঠতার তালিকা পরিবর্তনে শিক্ষকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আগের তালিকা ফিরিয়ে দিতে অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬২তম সভায় ৭৬তম সভার নির্দেশনা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার তালিকা পূর্বাবস্থায় ফেরানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এর আগে সার্বিক বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়ে। দুদক মাউশিকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেয়। মাউশি তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। ওই কমিটি পদোন্নতির প্রক্রিয়া বিধিপরিপন্থি উল্লেখ করলেও তাতে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের কোনো দায় নেই বলে উল্লেখ করে। কমিটি তাদের সুপারিশে সম্পূর্ণ দায় গভর্নিং বডির উল্লেখ করে।

সবশেষ ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে। জানতে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘কলেজ শাখা থেকে অভিযোগের কপি এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শামসুল আলম খান বলেন, কিছুদিন আগে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান তিনি।

মাউশি ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক (কলেজ) অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, নিয়োগের জন্য জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি, মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও গ্রহণযোগ্য কমিটির প্রয়োজন। এর বাইরে নিয়োগ দেওয়া হলে সেটি বিধিবহির্ভূত। বিধি অনুযায়ী নিয়োগ না পেলে তাদের এমপিওভুক্তি হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

এএএইচ/এমএএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।