হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন হতে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ এবং অনিশ্চয়তার ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে আমূল পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি তিনি ইতোমধ্যেই দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় নীতি বিষয়ক বহু প্রতিশ্রুতিও দিতে দেখা গেছে এই রিপাবলিকান প্রার্থীকে। খবর বিবিসির।
যদিও সেখানে এই নীতির বিষয়ে বিশদ বিবরণের অভাব ছিল। ‘হস্তক্ষেপহীন’ এবং ‘বাণিজ্য সুরক্ষাবাদের’ নীতির ওপর ভিত্তি করেই নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েন ট্রাম্প। এই নীতিকে মূলত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলেই আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
বহু বছরের ‘সমান্তরাল সংকটের’ আবহে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্ভাব্য বাধাগুলোর একটার সম্মুখীন হতে চলেছে, তারই ইঙ্গিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নির্বাচনী জয়।
কেমন হতে পারে এই পরিবর্তিত আবহ তার একটা আভাস মিলতে পারে প্রচারাভিযানের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকাকালীন তার ট্র্যাক রেকর্ড থেকে।
রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ন্যাটো
নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় ট্রাম্পকে একাধিকবার বলতে শোনা গেছে যে, তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ ‘একদিনে বন্ধ’ করে দিতে পারেন। তবে সেটা কীভাবে করবেন সেই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য তিনি কিছু বলতে চাননি।
গত মে মাসে ট্রাম্পের দুই প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানের লেখা এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা উচিত। তবে কিয়েভের রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় প্রবেশের বিষয়কে শর্তসাপেক্ষে সমর্থন করা উচিত।
রাশিয়াকে ‘প্রলুব্ধ’ করতে, পশ্চিমারা ন্যাটোতে ইউক্রেনের বহু কাঙ্ক্ষিত অন্তর্ভূক্তিকে বিলম্বিত করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে এ বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টারা বলেছিলেন, ইউক্রেন যে রাশিয়ার দখল থেকে তাদের সব অঞ্চল ফিরে পেতে পারে, সেই আশা ত্যাগ করা উচিত নয়। তবে এই আলোচনা হওয়া উচিত বর্তমানের ‘ফ্রন্ট লাইনের’ ভিত্তিতে।
ট্রাম্পের বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তার বিরুদ্ধে প্রায়ই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলে থাকে। তাদের দাবি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি ইউক্রেনের জন্য আত্মসমর্পণের সমান। শুধু তাই নয়, তার এই নীতি সমগ্র ইউরোপকেই বিপদে ফেলবে।
এদিকে তাকে ধারাবাহিকভাবে বলতে শোনা গেছে যে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং যুদ্ধের কারণে মার্কিন সম্পদের অপচয় বন্ধ করা তার কাছে অগ্রাধিকার পাবে। এখন তার দুই সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানের গবেষণাপত্রের তথ্যের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজস্ব চিন্তা কতটা মিলবে সে নিয়ে হয়ত একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু এটা অনুমান করা যেতে পারে যে তিনি কী ধরনের পরামর্শ পেতে চলেছেন।
যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গি ন্যাটোর ভবিষ্যত সম্পর্কিত কৌশলগত ইস্যুতেও প্রভাব ফেলতে পারে। এই মুহূর্তে ৩০টিরও বেশি দেশ ন্যাটোর অংশ। কিন্তু ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই এই জোটের বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। অন্যদিকে আমেরিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতির সুযোগ ইউরোপ নিচ্ছে বলেও অতীতে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
তবে ন্যাটো থেকে সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন কি না সেটা একটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু যদি তা হয়, তাহলে সেটা প্রায় শতাব্দীর প্রাচীন ট্রান্স-আটলান্টিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কের বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত হবে।
এদিকে ট্রাম্পের কিছু মিত্র বলছে, তার এই কড়া অবস্থান ন্যাটোর সদস্যদের জোটের প্রতিরক্ষা ব্যয় সংক্রান্ত নির্দেশিকা পূরণ করানোর জন্য দরকষাকষির কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু বাস্তবে, তার এই জয় ন্যাটোর ভবিষ্যতের জন্য কী বার্তা বয়ে আনে এবং বিদ্রোহী নেতারা এর ‘নেতিবাচক’ প্রভাবকে কীভাবে দেখবেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন জোটের নেতারা।
মধ্যপ্রাচ্য
ইউক্রেনের মতোই মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর অর্থ হলো তিনি গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের ইতি টানবেন। কিন্তু তা তিনি কীভাবে করবেন সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
তিনি বারবার দাবি করেছেন, জো বাইডেনের পরিবর্তে যদি তিনি ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে ইরানের ওপর তার ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের নীতির কারণে হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করতো না।
অনুমান করা যায় যে, ক্ষমতায় এসে তার দ্বিতীয় মেয়াদেও ট্রাম্প সেই নীতিই মেনে চলার চেষ্টা করবেন যার ভিত্তিতে তার প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনেছিল। সে সময় ইরানের ওপর বৃহত্তর নিষেধাজ্ঞা জারি এবং ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়।
প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলপন্থি নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমে স্থানান্তর করেন তিনি। তার এই পদক্ষেপ খ্রিষ্টান ‘এভাঞ্জেলিকাল’দের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। রিপাবলিকানদের ভোটার বলে বিবেচিত হয় এই গোষ্ঠী।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ইসরায়েলের সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্প প্রশাসনকে বয়কট করেছিল। কারণ ফিলিস্তিনিদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনের ঐতিহাসিক কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও জেরুজালেমের প্রতি তাদের (ফিলিস্তিনিদের) দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি ওয়াশিংটন।
ফিলিস্তিন আরও ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ে যখন ট্রাম্প তথাকথিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর মধ্যস্থতা করেছিলেন যাকে ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব ও মুসলিম দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হিসাবে দেখা হয়।
এই মধ্যস্থতার সময় শর্ত হিসাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ফিলিস্তিনকে মেনে নিতে হয়নি। এর পরিবর্তে, এই চুক্তিতে সামিল দেশগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে উন্নত মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছিল। এতে ধীরে ধীরে আরও কোণঠাঁসা হয়ে পড়ে ফিলিস্তিন।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় বেশ কয়েকটি বিবৃতি দিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন যে, তিনি গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান চান। কিন্তু নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার একটা জটিল সম্পর্ক রয়েছে, যা মাঝে মাঝে ‘অকার্যকর’ অবস্থারও সম্মুখীন হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ করার ক্ষমতা তার রয়েছে।
অন্যদিকে, আরব দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক ভালো। তবে সংঘাতের কারণে অস্থির মধ্যপ্রাচ্যে, তার এই দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে কার্যকর হবে সেই বিষয়টা স্পষ্ট নয়।
হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে গাজার যুদ্ধবিরতি বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন যে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছিল, তা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। সেই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া কীভাবে চালু হবে বা আদৌ তা শুরু হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প।
চীন ও বাণিজ্য
চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সে দেশের বৈদেশিক নীতির কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্ষমতায় থাকাকীল, ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে সে দেশের ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। একইসঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু ক্ষেত্রে চীনা আমদানির ওপর শুল্কও আরোপ করেছিলেন। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে মার্কিন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেইজিংও শুল্ক আরোপ করে।
এই ‘দ্বন্দ্বের’ অবসান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু ততদিনে কোভিড মহামারীর প্রকোপ দেখা দেয়। দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি হয় যখন ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যা দেন।
সে সময় বাইডেন প্রশাসন দাবি করে যে, তারা চীন নীতির প্রতি আরও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই চীনা আমদানির ক্ষেত্রে ট্রাম্প-প্রশাসনের শুল্ককেই বজায় রেখেছে তারা।
বাণিজ্য নীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প, উৎপাদন এবং সেই সংক্রান্ত কাজে মার্কিনদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে জুড়ে দিয়ে ভোটারদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে ইস্পাতের মতো ঐতিহ্যবাহী মার্কিন শিল্পে দীর্ঘমেয়াদী চাকরির সুযোগ কমে আসার একটা বড় কারণ কারখানার অটোমেশন এবং উত্পাদনগত পরিবর্তন। এর পেছনে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং অফ-শোরিংর মতো কারণ তুলনামূলক ভাবে কমই দায়ী।
ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে একই সঙ্গে বিপজ্জনক এবং একজন অত্যন্ত কার্যকর নেতা হিসাবে প্রশংসা করেছেন। তার মতে, এই নেতা ১৪০ কোটি মানুষকে লৌহ মুষ্টি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন। তার এই বক্তব্যকে বিরোধীরা ‘স্বৈরশাসকদের’ সম্পর্কে ট্রাম্পের প্রশংসা হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সুরক্ষার বিষয়ে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার যে নীতি বাইডেন প্রশাসন নিয়েছিল সেখান থেকে ট্রাম্প সরে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্ব-শাসিত তাইওয়ানের জন্য সামরিক সহায়তা বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে চীন তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসাবে দেখে এবং মনে করে সেখানে শেষ পর্যন্ত বেইজিংয়েরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে। গত অক্টোবরে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন যে, যদি তিনি হোয়াইট হাউজে ফিরে আসেন, তাহলে তাকে চীনা অবরোধ ঠেকাতে তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা দিতে হবে না। এর কারণ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানেন যে, তিনি ‘উন্মাদ’ এবং তিনি চীনের ওপর এমন শুল্ক আরোপ করবেন যা ওই দেশকে ‘পঙ্গু’ করে দিতে পারে।
টিটিএন